একজন ইউরোপিয়ান স্কলার/শিক্ষক অনেকদিন ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে পরিচিত। দুই দিন আগে তিনি প্রথমবারের মত বুয়েটে গিয়েছিলেন একটি একাডেমিক মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে। এরপর তার সাথে আমার দেখা হলে বললেন ‘WOW কামরুল বুয়েটের পরিবেশ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মান খুবই ভালো। ওদের ক্যাম্পাসের পরিবেশ যেমন ভালো শিক্ষক শিক্ষার্থীরাও তেমনি awake’। বুয়েটও যেহেতু আমার দেশেরই একটা প্রতিষ্ঠান সেহেতু একজনের ইউরোপেনের মুখে এই প্রতিষ্ঠান সম্মন্ধে উচ্ছসিত প্রশংসা শুনে আমার মনটা ভরে গেল। একই সাথে কষ্টও লাগছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার মুখে কখনো কোন প্রশংসা শুনিনি। বরং নেতিবাচক মন্তব্যই শুনেছি। সত্যিই তাই।
বুয়েট থেকে লেখাপড়া করে তাদের প্রতি ক্লাসের একটা বিরাট অংশ আমেরিকায় যায়। আমেরিকার সেরা সেরা প্রতিষ্ঠান যেমন এমআইটি, ক্যালটেক, স্ট্যানফোর্ড, প্রিন্সটনের মত প্রতিষ্ঠানেও নিয়মিত পিএইচডি করতে যাচ্ছে। সেইসব প্রতিষ্ঠানে পিএইচডি এমনকি পোস্ট-ডক করে ফিরে এসে বুয়েটের শিক্ষক হচ্ছে। যদিও একটা বড় অংশ ফিরে আসছে না। বুয়েটের শিক্ষকরা গবেষণার জন্য প্রণোদনা পায়। ভালো জার্নালে আর্টিকেল প্রকাশ করলে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা পায়। বুয়েটে টিচিং এসিস্টেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। তা ছাড়াও বুয়েটের শিক্ষকদের পার্ট-টাইম অন্যত্র পড়াতে হয় না। নিজ ক্যাম্পাসে বসেই অনেক কনসাল্টেন্সি করে ভালো আয় করে। তাদের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক স্বচ্ছ এবং অনেকটা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। তারা “Research and Innovation center for Science & Engineering বা RISE নামে একটি সেন্টার করেছে যার মাধ্যমে শিক্ষক ও গবেষকদের প্রজেক্টের এগেইনস্ট-এ বড় বড় ফান্ড দিচ্ছে। তাদের ক্লাস রুম ও কনফারেন্স রুমও খুব ভালো। বুয়েট থেকে পাশ করে বিশ্বসেরা অনেক প্রতিষ্ঠানে ফ্যাকাল্টি হয়েছে, বিশ্বের খ্যাতিমান অনেক কোম্পানিতে রিসার্চ & ডেভেলপমেন্ট সেক্শনে চাকুরী করছে। ওদের এখন দরকার শক্তিশালী পিএইচডি প্রোগ্রাম এবং তার জন্য দরকার পোস্ট-ডক নিয়োগ। এর মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল ছাত্র ও পোস্ট-ডক পেলেই তাদের রেঙ্কিং অনেক বেড়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৫৬ টির মত গবেষণা সেন্টার আছে। এইটা নিয়ে আমি বেশ কয়েকবার লিখেছি। এতগুলো সেন্টারের কি আউটপুট? প্রতিটি সেন্টারের একজন পরিচালক আছে। প্রতি বছরেই তাদের মোটামোটি ভালো অংকের বরাদ্দ দিতে হয়। অথচ কখনো তাদের আউটপুট নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি। কয়েকদিন আগে একটা মিটিং-এ থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে বর্তমান ভিসি এই প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন এই ৫৬ টির অধিকাংশেরই কোন আউটপুট নেই কিন্তু বরাদ্দ আছে। উনার কথায় মনে হলো এইগুলোর সংখ্যা কমিয়ে এনে যেই টাকা সাশ্রয় হবে সেই অর্থ দিয়ে বুয়েটের RISE এর মত একটি সেন্টারের মাধ্যমে কিংবা বোস সেন্টারের মাধ্যমে গবেষণা প্রকল্পের এগেইনস্ট-এ অর্থ বরাদ্দ দিলে গবেষণার মান বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন।
ভালো জার্নালে প্রকাশ করে ভালো প্রণোদনা দিয়েও উৎসাহ দেওয়া যায়। কারো বিশ্বমানের ৫০ টি আর্টিকেল আছে আর কারো দেশের গার্বেজ জার্নালে ২০ টি আর্টিকেল আছে কিন্তু দ্বিতীয়জন বয়সে বড়। তাতে কি দুইজন এক সমান হয়ে গেল। অবশ্যই প্রথম জনকে কোন না কোনভাবে মূল্যায়িত করতে হবে.নচেৎ ভালো গবেষক তৈরী হবে না। হাউস টিউটর, কিংবা বিএনসিসি কিংবা প্রক্টরিয়াল কাজের জন্য প্রমোশনের নম্বর না দিয়ে গবেষনা পত্রের সংখ্যা এবং মানের ভিত্তিতে প্রমোশনকে উৎসাহিত করলে গবেষনা বৃদ্ধি পাবে বলে আমার বিশ্বাস। সুসংবাদ হলো আমাদের বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর মনে হচ্ছে এইসব বিষয়ে aware এবং অনেক বছর ধরে এইসব জঞ্জাল পরিষ্কার করতে চাচ্ছেন।
লেখক: কামরুল হাসান মামুন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন