এডুকেশন টাইমস
১৮ জুন ২০২৪, ১২:৫২ অপরাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাক্সিম গোর্কি 

শাকিল শাহরিয়ার:

সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষেরা- চোর, লম্পট, ভবঘুরে, মাতাল, বেশ্যা, চাষি, মজুর, জেলে, সারিবদ্ধভাবে প্রকাশ পেয়েছে যার লেখায় তিনি ম্যাক্সিম গোর্কি। বিশ্বসাহিত্যের সেই কালজয়ী কথাশিল্পী ম্যাক্সিম গোর্কির ৮৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

সাহিত্যিক হিসাবে গোর্কির খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা ছড়িয়েছিল রুশ বিপ্লবের অনেক আগে থেকেই। তাঁর লেখালিখি চেকভ বা তলস্তয়ের সাথে তুলনীয় হয়ে ওঠে সেই সময়। তিনি নানা সময়ে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও আমেরিকার নানা দেশে গিয়েছেন, নানা বিখ্যাত মানুষের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। যাদের মধ্যে জর্জ বার্নার্ড শ বা এইচ ডি ওয়েলশ-এর নাম করা যায়।

বিখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কি ১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ রাশিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন । ম্যাক্সিম গোর্কি তার ছদ্ম নাম। তাঁর আসল নাম অ্যালেক্সি ম্যাক্সিসোভিচ পেশকভ।

বাবা-মায়ের মৃত্যু, অনাহার, অবহেলা, ছেড়া ময়লা জামাকাপড়, মনিবের প্রহার,রূঢ় ব্যবহার, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আলেক্সেই পেশকভকে ধীরে ধীরে ম্যাক্সিম গোর্কি করে তুলেছিল। গোর্কি নামটি তার নিজেরই রাখা। রাশিয়ান ভাষায় গোর্কি শব্দের অর্থ হল ‘বেজায় তেতো’। কেউ কেউ বলেন গোর্কির পিতা ছিলেন ঠোঁটকাটা ধরনের। তাই তাঁকে অনেকে ডাকতেন গোর্কি বলে। সেই থেকেই পুত্র সম্ভবত এই নাম নিয়েছিল।

কাজানে গোর্কি ছিলেন অনেকদিন। সেখানে তাঁর আশ্রয় ছিল পুরনো ভাঙা একটি বাগানবাড়ি। সেখানে গণিকা, জেলফেরত কয়েদী, ক্ষয়রোগী, বিপ্লবী থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের ছাত্ররাও থাকত। তাঁদের জীবনযাপন, পরবর্তী দিনে গোর্কির সাহিত্যে আখ্যান হয়ে ধরা দেয়। শাসকশ্রেণীর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সবসময়ই সরব ছিলেন গোর্কি।

গোর্কির লেখা সবথেকে বিখ্যাত উপন্যাস হচ্ছে মা। দুনিয়া কাঁপানো অক্টোবর সমজিতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বেকার উত্তাল রাশিয়ার জনজীবন হচ্ছে এই উপন্যাসের পটভূমি।

জার সরকারের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সকল স্তরের মানুষের বিক্ষুব্ধ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন মাক্সিম গোর্কির মতো সমাজ সচেতন লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও। এই আন্দোলনের পটভূমিতেই গোর্কি সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর অন্যতম মহৎ উপন্যাস মা।

প্রচলিত ধারণা হচ্ছে সমাজ বা পৃথিবীর যত পরিবর্তন সাধিত হয়, তার নেতৃত্ব দান করেন অগ্রসর চিন্তা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী কিছু মানুষ। এরাই ইতিহাসের বীর। ইতিহাসে এই মানুষগুলিই বীর বা নায়ক হিসাবে পূজিত হয়ে থাকেন। গোর্কি এই ধারণার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন যে বীর বলে আলাদা কিছু নেই। সাধারণ মানুষই ইতিহাস নির্মাণ করে, এবং সাধারণ মানুষরাই ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন করে। বিশেষ পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনের কারণে মানবসমাজে যে রূপান্তর সাধিত হয়, সেই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষই পরিবর্তিত হয়ে যায় অসাধারণ মানুষে। তারই আদর্শ উদাহরণ গোর্কির লেখা ‘মা’ উপন্যাসের মা ও তার ছেলে পাভেল।এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মা-কে বিপ্লবী মা হয়ে ওঠার জন্য আলাদা কোনো পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণের প্রয়োজন হয়নি। সাধারণ একজন মা-ই হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ।

মা উপন্যাসটির সামাজিক মূল্য এক কথায় তুলোনাহীন। একটি উপন্যাস একটি জাতির বিবেককে বদলে দিয়েছে, তুমুলভাবে আলোড়ন আলোকিত করেছে। এমন উদাহরণ বিশ্ব সাহিত্যে আর আছে বলে মনে পড়ে না। পেলাগেয়া নিলভনা নামের একজন অতিসাধারণ মেয়ে মানুষ কি করে সময়ের প্রয়োজনে আস্তে আস্তে রূপান্তরিত হন একজন রাজনীতি সচেতন ব্যাক্তিতে, বুঝতে শেখেন সারাজীবন কি করুন কাটিয়েছেন শ্রেণীগত নির্য়াতন ও লিঙ্গ অবস্থানের অসহায়তার শিকার; তা চমৎকার ভাবে বর্ণনা করেছেন গোর্কি তার দূর্দান্ত ভাষারীতিতে লেখা এই উপন্যাসটিতে।

কারখানার শ্রমিকদের দৈনন্দিন নিদারুন কষ্ট আর একঘেয়ে জীবন। যেখানে নেই কোন আনন্দ,নেই কোন উচ্ছাস। যেখানে প্রতিদিন কারখানার যন্ত্র তাদের ভিতর কার রক্ত চুষে নিচ্ছে, তাদের কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর গহ্বরের দিকে। তাদের কোন ইচ্ছা ছিলোনা এই জীবন ধারাকে পরিবর্তন করার।

রাশিয়ার বিখ্যাত একটি সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ১৮ জুন, ১৯৩৬ সকাল ১১টা ১০ মিনিটে মারা যান গোর্কি। মস্কো রেডিও ঘোষণা করল, “মহান রাশিয়ান লেখক, শ্রমিকদের বন্ধু, সাম্যবাদের চিরযোদ্ধা ম্যাক্সিম গোর্কি মারা গেছেন।” তৎকালীন সরকার গোর্কির চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যার অভিযোগ আনে। কয়েকজনকে শাস্তিও দেওয়া হয়। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতাকেও সন্দেহের তালিকায় এনে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

গোর্কির মৃত্যু নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। রাশিয়ান ঐতিহাসিক আরকেডি ভ্যাক্সবার্গ দাবি করেন –”গোর্কির মৃত্যু হৃদযন্ত্রের গোলযোগের কারনে হয়নি, স্তালিনের নির্দেশে বিষক্রিয়ার কারণে হয়েছিল।যদিও এই বিষয় নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব রয়েছে।” আরকাদ ভাস্কবেরগ তাঁর লেখা “The Murder of Maxim Gorkey” বইয়ে যুক্তি দিয়ে উল্লেখ করেন গোর্কির মৃত্যু রহস্য। ১৯৩৬ সালের ১৯ জুন নিউইয়র্ক টাইমসে বার্নার্ড ‘শ গোর্কি সম্বন্ধে বলেন-“Gorkey was semi-political figure in Soviet Russia.” বিখ্যাত কমিউনিস্ট পত্রিকা”RedFlag” অবশ্য মনে করে একেবারে অন্য কথা, তাঁরা মনে করেন সেযুগে প্রলেতারিয়ান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি সহ অন্যান্য লেখকদের হত্যা করিয়েছিলেন ট্রটস্কি।

রাশিয়ার সাহিত্যজগতে মাক্সিম গোর্কির স্থান অনেক উঁচুতে। সাধারণ মানুষ যেমন তাঁর রচনা পাঠ করেছে গভীর সহমর্মিতার সাথে, তেমনই বিদগ্ধ সমালোচকরাও তাঁকে স্থান দিয়েছেন অনেক উঁচুতে। রুশসাহিত্যের প্রথম লেখক হিসাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ইভান বুনিন। সেই বুনিনের চাইতে সমকালীন গোর্কিকে অনেক ওপরের স্তরের লেখক বলে দাবি করতেন রুশবাসী।

নোবেল পুরস্কার পাননি মাক্সিম গোর্কি। তার চাইতে বড় পুরস্কার পেয়েছেন। সে পুরস্কার হচ্ছে বিশ্ব মানবতার মুক্তিযাত্রার সহযোদ্ধার স্বীকৃতি।

 

ইএইচ/

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাসিনা ও তার দোসরদের পুনর্বাসনের প্রশ্নই আসে না: সারজিস

ইবি মফিজ লেকের নাম হবে ‘মীর মুগ্ধ সরোবর’ – উপাচার্য

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করবে মিত্র যুক্তরাজ্য

জবির মার্কেটিং অ্যালামনাইয়ের সভাপতি সৈকত , সম্পাদক রাজ্জাক

১৮ বছর পর প্রকাশ্যে নবীনদের বরণ করল হাবিপ্রবি শাখা ছাত্রশিবির

ওয়ান ব্যাংকে নিয়োগ, প্রবেশনে বেতন ৫৫,০০০ টাকা

ছাত্রশিবির শতভাগ মাদকমুক্ত: শিবির সেক্রেটারি

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ-আহতদের বিষয়ে মাউশির নতুন নির্দেশনা

মেডিকেল ভর্তি বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে যা জানা গেল

ববিতে মানবধিকার সংগঠন ‘সোচ্চার স্টুডেন্টস’ নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু

১০

আবারো মহাসমাবেশের ডাক চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশীদের

১১

পিকনিকে গিয়ে প্রাণ হারালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী

১২

জাবিতে জুলাই হামলার তদন্ত কমিটির প্রধানকে প্রাণনাশের হুমকি

১৩

প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ১০টি বাসে করে শিক্ষা সফরে নিয়ে গেল রাবি ছাত্রশিবির

১৪

সিভিল এভিয়েশন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বড় নিয়োগ, দেবে আবাসন ও নগর ভাতা

১৫

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি

১৬

মেডিকেল ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হবে যেদিন

১৭

জামায়াতে ইসলামীর ভারত-বিরোধিতা ধারণা ভিত্তিহীন: ডা. শফিকুর রহমান 

১৮

আগোরায় চাকরি, সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিনসহ দেবে নানান সুবিধা

১৯

ববির ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের নাইট শর্টপিচ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন একাদশ ব্যাচ

২০