রাতুল সাহা, বুটেক্স: বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) দশটি বিভাগের মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) একটি। ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করা বিভাগটিতে রয়েছে ল্যাব সংক্রান্ত নানা সমস্যা। আইপিই ল্যাবে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকা, আধুনিক মেশিনারিজের অভাব, পুরাতন মেশিনগুলো অচল হয়ে থাকা, নষ্ট মেশিনগুলো মেরামত না করা, দক্ষ ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর না থাকাসহ নানা সমস্যা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের।
টেক্সটাইল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের অন্তর্ভুক্ত এই বিভাগটিতে প্রতি বছর ভর্তি হয় ৪০ জন শিক্ষার্থী। পুরো চার বছরে একাডেমিক কোর্স ক্রেডিট সংখ্যা ১৬৬। এর মধ্যে ১২৯ ক্রেডিটের কোর্স হলো তাত্ত্বিক এবং ৩৭ হলো ব্যবহারিক। ৩৭ ক্রেডিটের ব্যবহারিক কোর্সের মধ্যে ২০ ক্রেডিটের কোর্স হলো আইপিই-এর কোর্স।
সাধারণত আইপিই ল্যাবগুলোতে ওয়েলডিং, মেটাল শপ, মেশিন শপ-এর জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ থাকে। সেখানে বুটেক্সের আইপিই ল্যাবে একই ছাদের নিচে ছোট জায়গাতে সবগুলো ব্যবহারিক করে দেখানো হচ্ছে। তাছাড়া স্থান সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক ক্লাসে মেশিনের গঠন, ব্যবহারবিধি ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারে না। সামনের দিকে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা ক্লাসগুলো বুঝে উঠলেও পেছনের দিকে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাস বুঝে উঠতে সমস্যা হয়।
প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের মেশিন শপ প্রাকটিস, ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং, ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাফিক্স এই ব্যবহারিক কোর্সগুলো করতে হয়। মেশিন শপ প্রাকটিস ল্যাবে নেই পর্যাপ্ত আধুনিক মেশিন। আর যেসব পুরাতন মেশিন রয়েছে তা অকেজো এবং বর্তমান যুগের সাথে যুগোপযোগী নয়। আধুনিক মেশিন ও সুযোগ সুবিধার কমতি রয়েছে এই ল্যাবটিতে।
ল্যাবের পুরাতন শেপার মেশিন দিয়ে কাঠ কাটা গেলেও মেটাল জাতীয় পদার্থ কাটা যায় না। ওয়েল্ডিং মেশিনও পর্যাপ্ত সংখ্যায় নেই। সাধারণত আইপিই ল্যাবে একসাথে ২০ হতে ২৫ জন শিক্ষার্থীর গ্রুপ ক্লাস করে। দেখা যায় যে, ১০০ মিনিটের ব্যবহারিক ক্লাসে ৩০-৪০ মিনিট লেকচার দিতে ব্যয় হলে বাকি সময়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীরা মেশিনগুলো ভালোভাবে ব্যবহার করে শেখার সময় পায় না। ল্যাবে সারফেস গ্রাইন্ডিং মেশিন, সিলিন্ড্রিকাল গ্রাইন্ডিং মেশিন-এর চাহিদা হ্যান্ড গ্রাইন্ডার, বেস গ্রাইন্ডার ও কাটিং স’ গ্রাইন্ডার মেশিন দিয়ে মেটানো হচ্ছে। আধুনিক সারফেস গ্রাইন্ডিং ও সিলিন্ড্রিকাল গ্রাইন্ডিং মেশিন এর অন্তর্ভুক্তি চাহিদা রয়েছে শিক্ষার্থীদের।
ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাফিক্স ল্যাবে কম্পিউটারগুলোতে সলিডওয়ার্ক্স ও অটোক্যাড সফটওয়্যারের কাজ শেখানো হয়। সেক্ষেত্রে পিসিগুলোতে উক্ত সফটওয়্যারগুলোর আপডেটেড ভার্সন ইন্সটল না থাকাসহ ল্যাবে কিছু সংখ্যক কম্পিউটার নষ্ট থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাসে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস ও ফান্ডামেন্টাল অব মেকানিকাল ইঞ্জনিয়ারিং এর ব্যবহারিক কোর্স করানো হয়। ল্যাবে মোট ১১টি মেশিন থাকলেও ইউনিভার্সাল টেস্টিং মেশিন দীর্ঘদিন যাবৎ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। লেদ মেশিন দুটি থাকলেও সেগুলো খুবই পুরোনো। এর পরিবর্তে আধুনিক লেদ মেশিন এবং একাধিক ওয়েল্ডিং মেশিনের প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিয়েছে। ল্যাবে নিজস্ব প্রজেক্টর না থাকায় শিক্ষকরা প্রয়োজনমতো স্লাইড প্রেজেন্টেশন করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব স্মার্টফোনের মাধ্যমে স্লাইডে প্রবেশ করে ক্লাস লেকচার অনুসরণ করতে হয়। এতে পাঠদানে দেখা যায় জটিলতা।
মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের জন্য একটি আলাদা মেকানিকাল ল্যাবের প্রয়োজন যেখানে বয়লার মেশিন, জেনারেটর, সেন্ট্রিফিউফগাল পাম্প, রেসিপ্রোকেটিং পাম্পসহ সিলেবাসের সাথে অন্তর্ভুক্ত আরও মেশিনারিজ থাকবে। কিন্তু এই সুবিধাগুলো না থাকায় শিক্ষার্থীরা ল্যাব ক্লাসে এসে শুধু থিওরি অংশটুকু বুঝে, মেশিন শেখার সু্যোগটুকুও পায় না। এদিকে কম্পিউটার নিউম্যারিকাল কন্ট্রোল (সিএনসি) মেশিন চালানোর জন্য দক্ষ প্রোগ্রামার বা ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর প্রয়োজন। ইন্সট্রাক্টরদের নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ট্রেনিং এর অভাবে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শেখা হচ্ছে না এই আধুনিক মেশিনগুলোর কার্যপ্রণালি। ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা ও দক্ষ ইন্সট্রাক্টরের সংখ্যা বাড়ানো দাবি করছে শিক্ষার্থীরা।
৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আশফাকুল ইসলাম হিমেল বলেন, আমার অনেকগুলো ব্যবহারিক কোর্স আইপিই ল্যাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। আমাদের ল্যাবে কোর্স আউটলাইন অনুযায়ী বেশ কিছু মেশিন উপস্থিত নেই যেমন: শেপিং মেশিন, হবিং মেশিন। কিছু মেশিন থাকার পরও নষ্ট হওয়ায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে আছে যেমন: ইডিএম (ইলেক্ট্রো ডিসচার্জ মেশিন)। এছাড়াও কাস্টিং এবং বিভিন্ন ধরনের ওয়েল্ডিং (SMAW ব্যতীত) এর ব্যবস্থা নেই যেগুলো আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস কোর্সের অন্যতম টপিক। পাশাপাশি ল্যাবে একটি এক্সপেরিমেন্ট-এর সময় গ্রুপের ২০ জনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা নেই, যার ফলস্বরূপ প্রত্যেকের এক্সপেরিমেন্টটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এছাড়াও মেশিন এর দক্ষ অপারেটর সংখ্যা খুব কম । ল্যাবে স্থায়ী একটি প্রজেক্টর না থাকার কারণে প্রতিবার এটি সেটআপ করতে অনেক সমস্যা দেখা যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাফিক্স কোর্সের ল্যাবটিতে সকল কম্পিউটারে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার যেমন: সলিডওয়ার্ক্স, অটোক্যাড শুরু থেকে ইন্সটল করা থাকেনা, যার কারণে প্রথম কয়েক ক্লাস পর্যন্ত এটি সব কম্পিউটারে ইন্সটল করতে হয় এবং এর ইন্সটলেশন প্রসেস সময়সাপেক্ষ। ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাব কোর্সের কোনো মেশিন বা সরঞ্জাম না থাকায় ব্যবহারিক কোর্সটি ক্লাসরুম এই অনুষ্ঠিত হয়। ফলে হাতে কলমে শিখার কোনো সুযোগ হচ্ছে না।
তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের মেজারমেন্ট, ইন্সট্রুমেন্টেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (এমআইসি) এবং প্রোডাক্ট ডিজাইন ল্যাব কোর্স করানো হয়। এমআইসি ল্যাবে ট্যাকোমিটার, লাইটমিটার, সাউন্ডমিটার, থার্মোমিটার, ডিজিটাল মাইক্রোস্কোপ একটি করে থাকলেও বাস্তবে তা চাহিদার তুলনায় কম। অপর্যাপ্ত মেশিন সংখ্যা ও সময় স্বল্পতার কারণে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে প্রতিটি যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখাটা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাবে থিওরি ক্লাসের ন্যায় ল্যাব ক্লাস গুলোও ক্লাসরুমে সংঘটিত হওয়ায় ব্যবহারিক ক্লাসের গুণগত মান ক্ষুন্ন হচ্ছে।
এসকল বিষয়ে ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাফিস সারওয়ার খান বলেন, মেকানিক্যাল ল্যাবের কোনো এক্সপেরিমেন্ট এর ইন্সট্রুমেন্ট আমরা পাই নি ল্যাবে। ক্লাসরুমে বসে স্লাইড দেখে দেখে ল্যাব শেখানো হয়। প্রোডাক্ট ডিজাইন ল্যাবে অন্যান্য ল্যাবের তুলনায় শেখার ক্ষেত্র বেশি। তবে এই ল্যাব কোর্সটি দুই সেমিস্টারব্যাপী হলে ভালো হতো। একটি কোর্সে এত বিপুল সিলেবাস শেষ করা অনেকটা অসম্ভব হয়ে যায়। এমআইসি ল্যাবের প্রথম কয়েকটা বাদে কোনো ল্যাবের এক্সপেরিমেন্ট এর প্রয়োজনীয় ইন্সট্রুমেন্ট নেই ল্যাবে। তাছাড়া ডিপার্টমেন্টের ল্যাবের কোর্সগুলোর সাথে টেক্সটাইলের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উচিত বলে মনে করি।
এ সমস্যাগুলো নিয়ে ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাহাদ বলেন, আমাদের আইপিই ল্যাবের অধিকাংশ মেশিনই সচল না।ফলে ল্যাব এক্সপেরিমেন্টগুলো অনেকটাই থিওরি কোর্সের মতো মনে হয়। তাই এক্সপেরিমেন্টগুলোর উদ্দেশ্য যথাযথভাবে সাধিত হয় না। এছাড়া ল্যাবে পর্যাপ্ত পরিমান জায়গার সংকট রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাফিক্স ল্যাবের অনেক কম্পিউটারে সলিডওয়ার্কস, অটোক্যাডের মতো সফটওয়্যার কাজ করে না।ফলে শিক্ষার্থীদের ল্যাবে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। আমাদের সিলেবাসে ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস এর থিওরি এবং ল্যাব দুটো কোর্সই রয়েছে।এই কোর্সের কাস্টিং প্রসেস টপিকটা থিওরিতে পড়ানো হলেও ল্যাবে ইকুইপমেন্ট না থাকায় আমাদেরকে এক্সপেরিমেন্টগুলো করানো হয় না। ফলে থিওরি বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয়।এমআইসি ল্যাবের ‘কন্ট্রোল’ এর এক্সপেরিমেন্টগুলোর সাথে থিওরির কোর্সের ‘কন্ট্রোল’ পার্টের কোন মিল পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান ড. মোহাম্মাদ রফিকুর রশিদ বলেন, পুরাতন ভবনের তিন তলায় নতুন এমআইসি ল্যাব হবে যেখানে ম্যাটেরিয়াল হ্যান্ডেলিং, মেকানিকাল এবং এমআইসি এর কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করা হবে। সম্প্রতি চারটি নতুন মেশিন এই ল্যাবে সংযোজন করা হয়েছে। দুটো ল্যাবের বাইরেও আরও ল্যাবের প্রয়োজন আছে। নতুন বাজেটে অর্থ বরাদ্দ পেলে আরও আধুনিক ও উন্নতমানের মেশিন কেনার এবং অচল মেশিনগুলো মেরামত করার পরিকল্পনা আছে। শিক্ষার্থীরা চাইলে ল্যাব ক্লাসের বাইরেও অন্য সময়ে ল্যাবে এসে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে পারে।
ইন্সট্রাক্টরদের ট্রেনিং এবং দক্ষ ইন্সট্রাক্টরের সংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সহকারী টেকনিকাল অফিসারকে সিএনসি মিলিং মেশিন এবং ইঞ্জেকশন মোল্ডিং মেশিন এর ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। সামনে ইডিএম মেশিন এর ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করানো হবে। দক্ষ ইন্সট্রাক্টর এর সংখ্যা বাড়ানোর ইচ্ছা আছে, তবে আমাদের জনবল সংকটও আছে।
এসআই/
মন্তব্য করুন