spot_img

বাংলাদেশে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া দশটি পেশা সম্পর্কে জেনে নিন

এসম্পর্কিত আরো পড়ুন

এডুকেশন টাইমস ডেস্ক: মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদেই কাজ করে। উপার্জানের জন্য বেছে নেয় নির্দিষ্ট পন্থা; যাকে বলা হয় পেশা। সময়ে পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে যায় কাজের ধরন। মানুষও তার পেশা পরিবর্তন করে। সময় ও মানুষের এই পরিবর্তনের ধারায় কাজের নতুন ধরন আসে, মানুষ নতুন পেশা গ্রহণ করে আর বিলুপ্ত হয় কিম্বা হারিয়ে যায় পুরোনো কাজ তথা পেশা। বাংলাদেশেও সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়েছে অনেক পেশা। এমনই দশটি বিলুপ্ত পেশা নিয়ে এই লেখা। চলুন জেনে নিই:

১. পালকি বেহারা:
পালকি ছিল এক সময়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন বাহন। মানুষ বহন করার কাজেই এর ব্যবহার হতো। সাধারণত ধনীগোষ্ঠী এবং সম্ভ্রান্ত বংশের লোকেরা এর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন। বিয়েতে ব্যবহৃত হতো পালকি। কিন্তু এখন তা প্রায় পুরোপুরি বিলুপ্ত।

- বিজ্ঞাপন -
ছবি: সংগৃহীত

২. ধুনারি:
তুলা ধুনা একটি অতি প্রাচীন পেশা। তুলা ধুনা করা পেশাজীবীরা লেপ, বালিশ ও তোষক প্রস্তুত করতেন। অতীতে তারা গ্রামে-শহরে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তুলা ধুনা এবং লেপ, বালিশ ইত্যাদি তৈরির কাজ করতেন। বর্তমানে ঢাকা শহরে এই পেশা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে তারা এখন লেপ-তোষক ইত্যাদি তৈরির বড় বড় দোকানে শ্রমিকের কাজ করে থাকেন। ঢাকা শহরের ধুনারিরা, যারা মুসলমান তারা বিহার থেকে এসেছেন বলে জানা যায়।

ছবি: সংগৃহীত

৩. গোয়ালা:
এক সময় ঢাকা শহরে গোয়ালাদের বসবাস ছিল। তারা গরু লালন-পালন করত এবং শহরবাসীর নিকট দুধ সরবরাহ করত। দুধ সরবরাহ ছাড়াও তারা দুধ দিয়ে ঘি, দই, ছানা তৈরি করত। ঢাকার মিষ্টি তৈরিকারকরা দুধের জন্য গোয়ালাদের উপর দারুণভাবে নির্ভরশীল ছিল। ১৮৩০ সালের আদমশুমারি থেকে জানা যায় যে, তখন ঢাকায় ৩৮২ ঘর হিন্দু গোয়ালা বাস করত।

ছবি: সংগৃহীত

৪. সাপুড়ে:
মোগল ঢাকা তো বটেই, ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত ঢাকায় জলা-জঙ্গলের অভাব ছিল না। ফলে সাপও ছিল প্রচুর। সাপুড়েও ছিল। তবে মূল শহর থেকে এই পেশা হারিয়ে গেছে। তাদের কাজ ছিল বাড়ি থেকে সাপ বের করা। বিশেষ করে গ্রামে বর্ষার শেষে সাপের প্রকোপ বেড়ে যেত। এ সময় বাড়ত তাদের কদর। তবে রাস্তা ঘাটে ছোটো ছোটো বক্স হাতে সাপ আছে বলে ভয় দেখিয়ে এখন যারা টাকা তোলে তাদের সাপুড়ে বললে ভুল হবে। বরং তাদের পরিচয় ‘বেদে’ হিসেবে।

ছবি: সংগ্রহীত

৫. বাইজি:
বিশেষ ধরনের জীবনযাপন, কঠোর পর্দার মধ্যে বসবাস এবং প্রহরীদের প্রহরায় ঘোড়াগাড়িতে যাতায়াত করতেন বাইজিরা। এ কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাইজিদের সম্পর্কে অনেক কৌতূহল ছিল। পাটুয়াটুলীর বাইজিরা সঙ্গীদের নিয়ে হেঁটে খুব সকালে বুড়িগঙ্গা নদীতে গোসলে যেতেন। তখন বুড়িগঙ্গা নদীর পানি ছিল খুবই স্বচ্ছ ও সুপেয়। গোসল পর্ব শেষে বাইজিরা যখন ফিরতেন তখন লোকজন গলির মুখে দাঁড়িয়ে থেকে সিক্ত বসনা বাইজিদের দেখে পুলকিত হতেন। কারণ এছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে বাইজিদের দেখার আর কোনো সুযোগ ছিল না।

ইংরেজ শাসন স্থায়ী হওয়ার পর বাইজি পেশায় ধীরে ধীরে ধস নামে। ঢাকার বাইজি পাড়ায়ও লাগে এর হাওয়া। নবাব, জমিদারদের আয়ের উৎস কমে যেতে থাকে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা আর সম্ভব হয়নি। তখন ঢাকায় নব্য ধনি শ্রেণির জন্ম হয়। তারা বাইজিদের নাচ-গান উপভোগের চেয়ে শ্বেতাঙ্গ রমণীদের সঙ্গে বলড্যান্স উপভোগ করতে অধিক অর্থ ব্যয় করতে উৎসাহী হয়ে উঠেন। এভাবেই ঢাকা শহর থেকে বাইজিরা হারিয়ে যেতে থাকে।

ছবি: সংগৃহীত

৬. নৈচাবন্দ ও টিকাওয়ালা:
হুঁকা এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হুঁকা নামের ধূমপানের বস্তুটি হারিয়ে গেছে। কিন্তু এক সময় ঢাকা শহরেই ছিল উপমহাদেশের বৃহত্তম হুঁকা বানানোর শিল্প। হুঁকার নল যারা বানাতো তাদের বলা হতো ‘নৈচাবন্দ’। ঢাকার নৈচাবন্দরা মূলত আসতো সিলেট থেকে। শিশু, জাম, জারুল, শিমুল কাঠ দিয়ে নৈচা বানানো হতো।

আজকের ঢাকার যে টিকাটুলি এলাকা তা ছিল মূলত হুঁকার টিকাদারদের আবাসস্থল। টিকাটুলির এই টিকাদাররা অতিসাধারণ টিকিয়াকে অসাধারণ শিল্পে পরিণত করেছিল। তাদের তৈরি টিকিয়ার কোনো তুলনা ছিল না। এগুলো এতো হাল্কা ও দাহ্য ছিল যে, দিয়াশলাইয়ের একটা শলা দিয়েই অনেকগুলো টিকিয়াতে আগুন ধরানো যেতো।

ছবি: সংগৃহীত

৭. পাঙ্খাওয়ালা:
হাতপাখা নির্ভর এই পেশাজীবীরা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রাজা-জমিদারদের আমলে এই পেশাজীবীদের অনেক কদর ছিল। বড় আকারের তালপাখার নাম ছিল আরানি, ছোটগুলোর নাম আরবাকি।

ছবি: সংগৃহীত

৮. ভিস্তিওয়ালা:
১৮৭৮ সালে ঢাকা শহরে আধুনিক সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয়। এর আগে ঢাকায় খাবার পানির উৎস ছিল পুকুর, কুয়া, নদী। সে সময় কিছু লোক টাকার বিনিময়ে মশকে (চামড়ার ব্যাগ) করে ঢাকা শহরের বাসায় বাসায় খাবার পানি পৌঁছে দিতেন। এ ধরনের পেশাজীবীদের বলা হত ‘ভিস্তিওয়ালা’ বা ‘সুক্কা’। আর ভিস্তিওয়ালা বা সুক্কারা পুরান ঢাকার যে এলাকায় বাস করতেন সেটি কালক্রমে ‘সিক্কাটুলি’ নামে পরিচিত হয়।

ছবি: সংগৃহীত

৯. রানার:
চিঠির গুরুত্ব অনেকটাই কমে এসেছে। টেলিগ্রাম, ফ্যাক্স, টেলিফোনের পর ইন্টারনেট পরিষেবা আসার পর ই-মেইল। চিঠির প্রয়োজনীয়তা তাই দিনদিন কমে আসছে। আর চিঠির গুরুত্ব কমে আসায় কমে গেছে এই মাধ্যমের সঙ্গে জড়িত মানুষদের গুরুত্বও। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতার দৌলতে সেরকম একটি পেশার সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ভালোই। কোন সময় থেকে রানারদের এই ‘দৌড়’ শুরু, তা সঠিক জানা যায় না। তবে মনে করা হয়, মোটামুটি মুঘল যুগের সময় থেকেই এই ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা।

প্রথমদিকে রাজাবাদশাদের প্রশাসনিক কাজের জন্য রানারদের নিয়োগ করা হতো। তারপর বণিকদের বাণিজ্য-সংক্রান্ত কাজেও রানাররা নিয়োজিত হতেন। খুব প্রত্যন্ত অঞ্চলেই কাজ করতেন এই রানাররা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করে চিঠির বোঝা পৌঁছে দিতেন অন্য আরেক রানারের হাতে। শুধু চিঠিই নয় বরং খামে করে টাকা পয়সার পরিবহনের কাজও করতেন রানার। তাই শুধু পরিশ্রম করার ক্ষমতা থাকলেই হতো না, পাশাপাশি সততাও ছিল রানার এর অন্যতম যোগ্যতা।

ছবি সংগৃহীত

১০. দাস্তানগড়িয়া:
এদের কাজ ছিল মূলত গল্প বলা। লোক সরগম হয় এরকম জনবহুল জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প বলতেন আর মানুষ দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে তা শুনতেন। রাজা বাদশার গল্প বা লৌকিক উপকথা সুন্দর বাচনভঙ্গির মাধ্যমে তারা শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন। এরই একটি পর্যায় বায়োস্কোপ। বায়োস্কোপে গল্পের পাশাপাশি কয়েকটি স্থিরচিত্রও দেখানো হতো। তবে পুঁথি পাঠকদের সঙ্গে তাদের মিলিয়ে ফেললে হবে না। যারা পড়তে পারতেন তারাই রাতে পুঁথি পড়তেন, আর অন্যরা দলবেঁধে শুনতেন। এর জন্য কোনো টাকা পয়সা নেওয়া হতো না। ৩টি পেশারই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।

এক নারী দাস্তান শোনাচ্ছেন, ছবিট তোলা ১৯১১ সালে।। ছবি: সংগৃহীত

প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরেই মূলত বিলুপ্ত হয়েছে পেশাগুলো। তাছাড়া সময়ের স্রোতে সঙ্গে কিছু পেশা হারিয়ে যাবে এইটাই নিয়তি। আজ যে পেশা রমরমা অবস্থা, সেটি হয়ত শত বছর পরে অতীত গল্পে পরিণত হবে।

তথ্যসূত্র:
১. মৃধা, প্রশান্ত (২০১৬), ‘হারিয়ে যাওয়া জীবিকা’, কথা প্রকাশ
২. বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র।

এসআই/

spot_img
spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ প্রকাশিত

spot_img