আজিজুর রহমান: হিমেল বায়ু আবছা কুয়াশাচ্ছন্ন মিষ্টি সকাল বাংলার প্রকৃতিতে হেমন্তের জানান দেয়। শরতের মলিনতা কাটিয়ে ধীর পায়ে আগমন ঘটে ঋতুকন্যা হেমন্তের। ষড়ঋতুর চতুর্থ হেমন্ত ঋতু। হিম বাতাস আর হালকা কুয়াশায় ঘেরা শীত শীত অনুভূতি শীতের আগমনি বার্তা দেয়। গাছের পাতা,ধানের শীষে আর ঘাসে মুক্তার মত জমে থাকা শিশির বিন্দু হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। হেমন্তের এই মায়াময় প্রকৃতি বাংলার মানব মননে তন্ময়তার অনুভূতি সৃষ্টি করে৷ হেমন্ত এমনই এক ঋতু যার চারদিকে বিরাজ করে মুগ্ধতা।ঋতুর সৌন্দর্য মোহিত স্নিগ্ধ এতটা যে, তার মোহ কাটিয়ে উঠা সহজ নয়৷ এসময় শরৎজুড়া আকাশের ঘন ঘন মেঘ কমতে শুরু করে। হেমন্তে নীলাকাশ থাকে মেঘমুক্ত। নীলের বাটি যেন উপুড় হয়ে পড়ে আছে হেমন্তের গগনে । শুভ্র শরতের পর ধোয়ামোছা পরিষ্কার আকাশ মন কেড়ে নেয়। আহ! কী তৃপ্তির সুবাস বাতাস। কাঁচা সোনার রঙ লেগেছে দিগন্তবিস্তৃত আমন- আউশ ধানের মাঠে মাঠে । মাঠে মাঠে শুরু হয় ধান কাটার ধুম। কৃষক কৃষশানী নতুন ধান ঘরে তোলায় থাকে কর্মব্যস্ত। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধে ম ম করে। এসময় গ্রাম বাংলায় বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। উঠানে শুকিয়ে, সেদ্ধ করে ঢেঁকিতে পাড়দিয়ে তৈরি করা হয় নতুন চাল৷ নতুন চালে তৈরি পিঠাপুলি, পায়েস ফরনি, ক্ষীর পড়শিদের বাড়িতে দেওয়া হয়। নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে দূরের আত্মীয় ও জামাই বাড়িতে গিয়ে জামাই নিমন্ত্রণ করা হয়। বিবাহিত মেয়েও বাপের বাড়িতে নাইওর নিয়ে আসা হয়। হেমন্ত গ্রাম বাংলায় ধান কাটার আর পিঠাপুলির আমেজ নিয়ে আসে না। বাংলার প্রকৃতিকে দেয় নানা স্বাদের ফল। হেমন্তে সচারাচর পাওয়া যায় জাম্বুরা, জলপাই, কদবেল, আমড়া, চালতা, আমলকী ও কামরাঙা। হেমন্ত প্রকৃতিতে কাননে কাননে সাজিয়ে দেয় ফুলের ডালি উজাড় করে ৷ এতের কারো রঙ সাদা, কমলা, হালকা লাল কিংবা রানি গোলাপি। ফুল মানুষের জীবনকে সাজায় হৃদয়কে রাঙায়। এসময় হাসনাহেনা, হিমঝুরি, শিউলি, ছাতিম, কামিনী, জবা, গোলাপ, রাজ অশোক, মলিস্নকা, বকফুল, দেব কাঞ্চন, দোলনচাঁপা ইত্যাদি ফুলে সাজে হেমন্ত। সন্ধ্যার হিমেল বাতাসে ভেসে বেড়ায় হাসনাহেনার সুঘ্রাণ। শুধু ফুল,ফল নয় শীতের আগাম শাক সবজি বাঁধাকপি, ফুলকপি, পালংশাক, মুলা কী নেই হেমন্তের বাজারে। ঋতু রানী হেমন্ত এমনিতেই তো আর রানীর মুকুট পায়নি। তার এমন সৌন্দর্য প্রাচুর্যের ঢের তাকে এনে দিয়েছে এই খ্যাতি। প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে বৈচিত্র্যময় রঙ্গের ও ঘ্রাণে দোলা দিয়ে যায় হেমন্ত। ঋতুকন্যা হেমন্ত ক্ষণস্থায়ী তেমনি তার বিকেলগুলো স্বল্পায়ু। হেমন্তের ঘুঘু ডাকা দুপুর, বাঁক খেয়ে ধানক্ষেতে নেমে আসা বালিহাঁসের ঝাঁক, কাকতাড়ুয়ার মাথায় বসে থাকা ফিঙে, শেষ বিকেলে পশ্চিম আকাশ রাঙিয়ে দেয়া সাত রঙের রংধনু। আর ভাবুক সন্ধ্যার প্রফুল্লতা ছেয়ে যায় মানুষের ভেতর জগৎ। জ্যোৎস্না ডুবানো আলোকিত রাতও যে প্রকৃতিকে করে তোলে অপরূপ। বাংলার হেমন্তকাল ধূসর পাণ্ডুলিপির কবি জীবনানন্দ দাশেরই। ভোরের কাক হয়ে কিংবা শঙ্খচিল, শালিকের বেশে যিনি এই কার্তিকের নবান্নের দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন কবিতায়। আদিপাঠের সূত্র মতে, ‘কাত্তিকা’ ও ‘আর্দ্রা’ নামক দু’টো তারকার নামানুসারে এ ঋতুর মাসদ্বয়ের নামকরণ করা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। কার্তিক মাসকে অঞ্চলভেদে ‘কার্তি’ বা ‘কাত্তি’ নামে অভিহিত করা হয়। যাকে গ্রামাঞ্চলের মানুষরা ‘মরাকার্তিক’ নামেই ডেকে থাকে। কার্তিক ও অগ্রহায়ণে বাংলার খাল বিলে- নদী নালা,ডোবায় পানি কমতে শুরু করে । হাওড়,বাওড়, বিল খালে তাই ধান কাটার মতো মাছ ধরার চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। নানারকম দেশীয় মাছে গ্রামগঞ্জের বাজার সয়লাব হয়ে যায়। টেংরা, পুঁটি, বোয়াল, চিতল, আইড়, শিং, মাগুর, কইসহ কত রকমের মাছ যে ধরা পড়ে এ সময়। কৃষশানীর রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে দেশীয় মাছের ঘ্রাণ। হেমন্তের নবান্নে বাঙালি হয়ে ওঠে মাছে ভাতে বাঙালি। এসময় গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুতি করতে থাকে। শীতের শুরুতে খেজুর রস সংগ্রহ করার জন্য৷ উঠানে তৈরি করা হয় খেজুর রস জ্বালানোর উনুন। কালের বিবর্তনে গুরুত্ব কমলেও হেমন্ত আজও কৃষকের ঘরে আনন্দের উৎস হিসাবে কাজ করে। শহরে হেমন্ত ঋতুর বৈশিষ্ট্য একটু ভিন্ন। শুধু হেমন্ত নয় সব ঋতুর বৈশিষ্ট্য শহরে তেমন দেখা যায় না। যান্ত্রিক আধুনিক সভ্যতার যুগে গ্রামবাংলায় হেমন্ত তার চিরচেনা রূপ হারিয়ে অনেকটা৷ কৃষি প্রধান গ্রাম বাংলায় হেমন্তের নবান্ন উৎসব পালন হলেও, ইট পাথরের যান্ত্রিক শহরে আগের মতো দেখা যায় না নবান্ন উৎসব পালন করতে। জলবায়ুর পরিবর্তনে হেমন্তের বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাচ্ছে।
এসএস/