আব্দুল্লাহ আল-জাবির: গবেষণা শুরু করা অনেকটা একটি অভিযানের মতো। এটি কেবল তথ্য সংগ্রহ বা পেপার লেখা নয়, বরং এটি একটি গভীর চিন্তা, ধৈর্য, এবং সৃজনশীল প্রক্রিয়া, যেখানে সঠিক দক্ষতা অর্জন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি তুমি গবেষণার জগতে নতুন হয়ে থাকো এবং কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে না পারো, তবে এই পোস্টটি তোমার জন্য। আসো, দেখি কোন কোন স্কিলগুলোতে ফোকাস করলে তোমার গবেষণার যাত্রা সহজ এবং কার্যকর হবে।
১. রিসার্চ মাইন্ডসেট তৈরি করা
গবেষণার মূল চাবিকাঠি হলো জিজ্ঞাসু মন। প্রতিটি ছোট বিষয়েও প্রশ্ন করতে শেখো ‘কেন?’ এবং ‘কিভাবে?’। একটি সমস্যা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য কৌতূহল জাগানো জরুরি। পাশাপাশি, ব্যর্থতাকে সহজভাবে গ্রহণ করে সেখান থেকে শেখার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি তুমি কেন গবেষণা শুরু করতে চাইছো সেটা নিজের কাছে খুব পরিষ্কার থাকতে হবে। নতুবা কিছুদূর গিয়ে থেমে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
২. গবেষণার টপিক নির্বাচন করা
একটি ভালো গবেষণা শুরু হয় একটি নির্দিষ্ট এবং বাস্তবসম্মত টপিক দিয়ে। অনেক সময় নতুন গবেষকরা বড় বড় বিষয় নিয়ে শুরু করে, যা পরে সামলানো কঠিন হয়ে যায়। প্রথমে একটি বড় বিষয়ের মধ্যে থেকে ছোট এবং নির্দিষ্ট টপিক বের করো। যেমন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ এর বদলে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় কৃষির প্রভাব’ এর মতো একটি নির্দিষ্ট টপিক বেছে নাও। এতে করে তোমার জন্য পুরো গবেষণাটি সম্পন্ন করা তুলনামূলক সহজ হবে।
৩. লিটারেচার রিভিউয়ের দক্ষতা অর্জন
লেটারেচার রিভিউ গবেষণার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন বিষয়। তোমার টপিক নিয়ে আগে কী কাজ হয়েছে তা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাসঙ্গিক গবেষণা পেপার, বই, আর্টিকেল পড়ার অভ্যাস করো। Google Scholar, PubMed, বা ResearchGate-এর মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে ভালো রিসোর্স খুঁজতে শিখো।
৪. রেফারেন্স ম্যানেজমেন্ট শেখা
গবেষণা করতে গিয়ে অনেক রেফারেন্স ব্যবহৃত হয়। এদের সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং ব্যবহার করার জন্য টুলস যেমন Mendeley, Zotero বা EndNote ব্যবহার করো। এগুলো তোমার সময় বাঁচাবে এবং রেফারেন্সের সঠিকতা নিশ্চিত করবে। পাশিপাশি রেফারেন্সের মৌলিক উপাদান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা জরুরি।
৫. বেসিক স্ট্যাটিস্টিক্স শেখা
গবেষণার ডাটা বিশ্লেষণের জন্য মৌলিক স্ট্যাটিস্টিক্স সম্পর্কে ধারণা থাকা খুবই জরুরি। মীন, মিডিয়ান, স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন থেকে শুরু করে রিগ্রেশন মডেল এসব বিষয়গুলো শিখে নাও। পাশাপাশি, SPSS, R Studio বা Excel-এর মতো সফটওয়্যার ব্যবহার শেখো। কারণ স্ট্যাটিস্টক্স বাদে গবেষণা প্রায় অসম্ভব।
৬. সুন্দরভাবে লেখার অভ্যাস গড়ে তোলা
গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতে গেলে লেখার দক্ষতা খুব দরকার। বিশেষ করে, কীভাবে সহজ ভাষায় জটিল বিষয় উপস্থাপন করতে হয় তা শিখো। লেখার সময় একটি ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করার অভ্যাস তৈরি করো। সম্ভব হলে লিংকড ইন, ফেসবুকে নিজের সাবজেক্টের উপর লেখালিখির অভ্যাস তৈরি করতে পারো এখন থেকে।
৭. টাইম ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা
গবেষণা হলো সময়সাপেক্ষ একটি কাজ। পরিকল্পনা ছাড়া এটি পরিচালনা করা কঠিন। কাজের তালিকা তৈরি করো, ডেডলাইন ঠিক করো, এবং প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখো। ক্লাস বা পরীক্ষার সময়ে কিভাবে টাইম ম্যানেজ করে গবেষণার কাজ এগিয়ে নিবে সে সম্পর্কে আগেই পরিকল্পনা করে রাখো।
৮. ক্রিটিকাল থিংকিং এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা
গবেষণার সময় বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। এজন্য ক্রিটিকাল থিংকিং বা সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। সমস্যাগুলোর কারণ বিশ্লেষণ করো এবং সৃজনশীল উপায়ে সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করো। তাছাড়া গবেষণা শিখতে গেলে নিজের স্বাভাবিক চিন্তা চেতনার উর্ধে গিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে। পাশাপাশি তোমাকে টিপিক্যাল চিন্তাভাবনা না করে আনবায়াসড চিন্তাভাবনার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
৯. প্রেজেন্টেশন স্কিল ডেভেলপ করা
গবেষণার কাজ শুধু নিজের জন্য নয়, বরং এটি অন্যদের সামনে উপস্থাপন করতেও হয়। স্লাইড তৈরি এবং কথা বলার কৌশল শিখে নাও দ্রুত। এটি তোমার আত্মবিশ্বাস বাড়াবে এবং তোমার কাজের গুরুত্ব অন্যদের কাছে ভালোভাবে তুলে ধরবে। মনে রাখতে হবে স্লাইড দেখে দেখে পড়ে যাওয়াই প্রেজেন্টেশন না।
১০. সহযোগিতার মানসিকতা তৈরি করা
গবেষণা একা করার বিষয় নয়। তোমার সহপাঠী, সিনিয়র, বা সুপারভাইজরের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে শেখো। একটি ভালো গবেষণার পেছনে দলগত কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। দলগত ভাবে কাজ করার দক্ষতা যত দ্রুত অর্জন করবে গবেষণা শেখা ও কন্ডাক্ট করা তোমার জন্য তত সহজ হবে। তাছাড়া অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করাও শিখতে হবে তোমাকে।
লেখা: আব্দুল্লাহ আল-জাবির
সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও পিএইচডি ফেলো, এআইটি, থাইল্যান্ড।