spot_img

হতাশ হলে আমার স্বামী কুরআনের আয়াত পড়ে অনুপ্রেরণা দিতেন: সহকারী জজ আয়েশা

এসম্পর্কিত আরো পড়ুন

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি জান্নাতুল আয়েশা রিতু। ২০১৩ সালে যখন কলেজে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনাই অনিশ্চিত ছিল তখন তাঁর মা গহনা বিক্রি করে মেয়ের শিক্ষার পথ সুগম করেন। এছাড়াও ডাচ বাংলা ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক-এর শিক্ষাবৃত্তির অর্থ দিয়ে কলেজে লেখাপড়া চালিয়ে যান। এভাবে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। আয়েশা ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।

তবে শিক্ষাজীবনের পথে অর্থাভাবের বাধা এসে দাঁড়ায়। তবু তিনি দমে যাননি, সেন্ট্রাল ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেএম) বৃত্তির সহায়তায় তিনি তার পড়াশোনা চালিয়ে যান। কঠোর পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে ধাপে ধাপে স্বপ্নের পথে এগিয়ে যান। তিনবার ব্যর্থ হওয়ার পরও তিনি হাল ছাড়েননি, চতুর্থ বারেই সফলতা অর্জন করেন।

- বিজ্ঞাপন -

তার সফলতার পথে তাঁর স্বামীও এক গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। বারবার ব্যর্থতার মুখোমুখি হলে তিনি তাঁকে সাহস, মনোবল ও উৎসাহ প্রদান করেন।

আয়েশার এই অদম্য সংগ্রামের ফলস্বরূপ, ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষায় সহকারী জজ পদে তিনি ৯৭তম স্থান অধিকার করেন। এভাবেই আয়েশার অনুপ্রেরণামূলক জীবনের গল্প তুলে ধরেছেন এডুকেশন টাইমস-এর পত্রিকার ক্যাম্পাস প্রতিনিধি আনিসুর রহমান

এডুকেশন টাইমস: ১৭তম বিজেএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনার জন্ম, শৈশবকাল সম্পর্কে জানতে চাই?

আয়েশা: আমার জন্মসাল ১২ অক্টোবর  ১৯৯৭ সালে। আমার বেড়ে উঠা সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার অন্তর্গত বয়ড়াবাড়ী গ্রামে। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর ১৬তম বিজেএস পরীক্ষার দেওয়ার পরে বাবা মারা যান। আমি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি গ্রামের একটি স্কুলে। ২০১৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। এরপর শুরু হয় জীবন যুদ্ধ। কলেজে ভর্তি হওয়ার টাকা নেই, মায়ের গহনা বিক্রি করে রাজশাহী নিউ গভমেন্ট ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হই। ২০১৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। এরপর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ার সুযোগ পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শুরু হয় আরো স্ট্রাগল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়াশোনা চালিয়েছি সেন্ট্রাল ফর যাকাত ম্যানেজমেন্টের (সিজেএম) টাকা দিয়ে। আমি ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়ির সকল কাজে মা-বাবা কে সাহায্য করেছি। কোনো কাজকে কখনোই ছোট মনে করিনি।

এডুকেশন টাইমস: এখন তো আপনি সহকারী জজের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। আপনার এ অনুভূতিটা সম্পর্কে বলুন।

আয়েশা: সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষা সন্দেহাতীতভাবে একটি কঠিন পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর জীবনের যত অপ্রাপ্তি ও ব্যর্থতার কষ্ট ছিল তা দূর হয়ে গেছে। তবে এই সফলতায় সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতেন আমার বাবা যিনি এ পৃথিবীতে আর নেই। বাবার শূন্যতায় এই প্রাপ্তি অপূর্ণই রয়ে গেলো।

এডুকেশন টাইমস: বিচারক হওয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা কে, কীভাবে এ স্বপ্নের শুরু হয়েছিল?

আয়েশা: ছোটবেলা থেকে নির্দিষ্ট কিছু হওয়ার স্বপ্ন না থাকলেও লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে এই লক্ষ্য সামনে রেখেই জীবনের প্রতিটি ধাপে এগিয়েছি। আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর বিভাগের বড় ভাই-আপুদের জজ হতে দেখে ইচ্ছে হলো আমিও জজ হবো। আব্বা- আম্মা আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে আমার জন্য দোয়া করতেন। আমার ব্যর্থতায় শান্তনা দিতেন। আবারো লেখাপড়া করার উৎসাহ দিতেন। আমার ভাইয়েরা পরামর্শ দিয়ে সবসময় আমার পাশে ছিলেন।

এডুকেশন টাইমস: বিচারক হওয়ার স্বপ্ন কখন থেকে? বিচারক হওয়ার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?

আয়েশা: ছোটবেলা থেকেই আমাদের ৫ ভাই-বোনের লেখাপড়ার প্রতি আমার আব্বা-আম্মা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হওয়ায় ঈদে কখনো নতুন জামা না পেলেও বই বা টিউশন ফি সবসময় আম্মা যোগার করে রাখতেন। আব্বা-আম্মার পরিশ্রম, সততা, দূরদর্শিতা, ধৈর্য্য সবকিছুই আমার বিচারক হওয়ার পেছনে অবদান রেখেছে। আম্মা বলতেন প্রয়োজনে রক্ত বিক্রি করে তোমাকে পড়াবো তবুও তুমি হাল ছেড়ো না। ২০২০ সালে অনার্স ৪র্থ বর্ষে আমার বিয়ে হয়। মূলত তখন থেকেই জজ হওয়ার জন্য লেখাপড়া শুরু করি।

আমার স্বামীও আইনের ছাত্র হওয়ায় দুজন আলোচনা করে আইন পড়তাম। কঠিন বিষয়গুলো সে খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন। সে আইনের নোট করতেন আর আমি জেনালের বিষয়ের নোট করতাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে আমাকে মানসিকভাবেও বিচারক হিসেবে প্রস্তুত করেছেন। যেমন একটা ঘটনা বলি রান্না করতে গিয়ে হাত কেটে বা পুড়ে গেলে সে বলতেন, ‘তোমার এই হাত শুধু কলম ধরার জন্যই উপযুক্ত।’ অতিরিক্ত কষ্টের মুহুর্তে কুরআনের আয়াত পড়ে সে আমার মধ্যে আশা জাগিয়েছেন। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ সহায়তা করেছেন।

এডুকেশন টাইমস: আপনার সাফল্যের পেছনে কোন বিষয়গুলো কাজ করেছে?

আয়েশা: আমি মনে করি বিচারিক পেশায় আশার জন্য শুধু লেখাপড়া করলেই হবে না বরং হতে হবে কৌশলী। আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা রেখে সঠিক দিকনির্দেশনায় থেকে সর্বোচ্চ পরিশ্রম করতে হবে।সেইসাথে ধৈর্য্য, মানুসিক স্থিরতা, সততা, বিনয়, সহনশীলতা ও কথাবার্তায় স্পষ্টতার মতো মৌলিক মানবীয় বিষয়গুলোর চর্চা করতে হবে এবং আফসোস ও অহংকার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শেষ সময়ে এই বিষয়গুলোর ওপর আমি বেশ গুরুত্ব দিয়েছি।

এডুকেশন টাইমস: অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার সাথে জুডিসিয়ারির পড়া কীভাবে সামলে নিয়েছেন?

আয়েশা: জুডিসিয়ারি পরীক্ষায় ৬০% প্রশ্ন সরাসরি আইন থেকে হয় আর সে আইনগুলোই আমরা ৪ বছরের অনার্স কোর্সে পড়ে থাকি। তাই অ্যাকাডেমিকে বাড়তি চাপ না নিয়ে আইনগুলো বুঝে বুঝে পড়েছি ও কিছুটা নোট করে মুখস্থ রাখার চেষ্টা করেছি।

এডুকেশন টাইমস: কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন, দিনে কত ঘণ্টা করে পড়ালেখা করেছেন?

আয়েশা: প্রস্ততির শুরুটা ছিল হাতের লেখা ঠিক করার মধ্য দিয়ে। আমার লেখা এতটাই খারাপ ছিল যে কী লিখেছি তা বোঝাই যেতো না। খাতায় মার্জিন টেনে অ, আ, ক, খ লিখতাম। যাদের লেখা সুন্দর তাদের খাতা এনে সেইভাবে লেখার চেষ্টা করতাম আর নিজে নিজে বলতাম লেখা সুন্দর করতে পারলে জজও হইতে পারব।

প্রতিটি আইনের প্রিলি ও রিটেনে জন্য আলাদা আলাদা নোট করে পড়েছি। প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি বুঝেবুঝে পড়েছি এবং বারবার রিভিশন করেছি। বুঝে পড়ার পাশাপাশি মুখস্থ করার ওপর ও বেশ গুরুত্ব দিয়েছি।

পড়ার সময় অন্যকোনো দিকে মনোযোগ দিতাম না। ফোন বালিশের নিচে রেখে দিতাম। ঘণ্টা ধরে কখনো পড়িনি তবে রুটিন করে প্রতিদিনের টার্গেট পড়া নিতাম এবং যতসময়ই লাগুক তা শেষ করতাম। এতে গড়ে দিনে ৮-১০ ঘণ্টা পড়া হতো।

এডুকেশন টাইমস: কতবার ভাইভা দিয়েছেন এবং কততম ভাইভাতে সফল হয়েছেন? আপনি তিনবার ব্যর্থ হয়েছেন? হতাশা হয়েছেন কি?

আয়েশা: ১৪তম-১৭তম বিজেএসে মোট ৪ বার অংশ নিয়েছি এতে ১৪, ১৬ এবং ১৭তম বিজেএস এ মোট ৩ বার ভাইভা দিয়েছি। ১৭তম বিজেএস-এর ভাইভতে উত্তীর্ণ হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। ৩ বার ভাইভা দিয়েছি, ১ বার প্রিলি থেকে বাদ পড়েছি। ৪র্থ ভাইভাতে সফল হয়েছি।

হতাশা এসেছে, এটা আসবেই, সেই সময়ে কুরআন থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আমার স্বামী (তাওহিদুল ইসলাম) হাফেজ হওয়ায় সে সব সময় কুরআন থেকে বিভিন্ন আয়াত ব্যাখ্যা করে আমার ঈমান বৃদ্ধিতে সাহায্য করতেন। কোনো মুমিন মুসলিম আল্লাহর সাহায্য থেকে নিরাশ হতে পারে না। রিজিক তো আসমান থেকে ফয়সালা হয় তাই হতাশার সময় আমি রিজিকের মালিক আল্লাহু তাআলার কাছেই সাহায্য চেয়েছি এবং প্রচুর দোয়া করেছি।

এডুকেশন টাইমস: বিচারক হিসেবে দেশের জন্য আপনি কি অবদান রাখতে চান?

আয়েশা: সততা ও ধৈর্যের সাথে বিচারিক দায়িত্ব পালন করে জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চাই।

এডুকেশন টাইমস: ভাইবার সময় কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে, আপনি কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?

আয়েশা: প্রিলি এবং রিটেনের পড়াগুলো রিভিশন করতে হবে, স্পষ্ট ও যথাসাধ্য শুদ্ধ ভাষায় গুছিয়ে কথাবলার অভ্যাস করতে হবে। মক ভাইভা দিতে পারলে ভালো হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতেই মানুসিকভাবে স্থির থাকতে হবে এমনকি ভাইভা বোর্ড থেকে অপমান করে বের করে দিলেও নার্ভাস হওয়া যাবে না, না খেয়ে বা খালি পেটে ভাইভা বোর্ডে যাওয়া যাবে না। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পর আমার আম্মা ও স্বামীর কাছে ভাইভা দিতাম। আম্মা আমার কথা বলার ধরণ ও আইকন্টাক্ট ঠিক করে দিতেন আর স্বামী আইনের ভুল ঠিক করে দিতেন।

এডুকেশন টাইমস: যারা বিচারক হতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

আয়েশা: লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে কারণ লিখিত পরীক্ষার নাম্বারের ওপরেই চূড়ান্ত সফলতা নির্ভর করে।একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বিষয় অনেকেই মনে করেন বাংলা, ইংরেজি ও বাংলাদেশ-আন্তর্জাতিক বিষয়ে তেমন প্রস্ততি না নিয়ে পরীক্ষার হলে বানিয়েই লেখা যাবে এটা একদমই ভুল ধারণা। বরং আগে থেকেই রচনা,ভাবসম্প্রসারণ,ব্যাকরণের মত বিষয়গুলো বারবার প্র্যাকটিস করতে হবে। আর বাংলাদেশ-আন্তর্জাতিক বিষয়ের জন্য এলোমেলো অনেক বই না পড়ে বিসিএস এর কোনো লিখিত বই থেকে বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত পড়তে হবে এবং বিশ্বের চলমান ঘটনার প্রতি নজর রাখতে হবে। অনেকেই আমার মতো ইংরেজিতে খুব দূর্বল তাদের বলব বিসিএস ও বিজেএস এর লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নগুলো বারবার প্যাকটিস করতে। জুডিসিয়ারির প্রশ্নগুলো বারবার বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ টপিক গুলোর ওপর বেশি জোর দিতে হবে।

এডুকেশন টাইমস: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

আয়েশা: এডুকেশন টাইমসকেও ধন্যবাদ। যারা জুডিসিয়ারির প্রস্ততি নিচ্ছেন তাদের জন্য অনেক শুভকামনা রইলো।সবাই দোয়া করবেন আমি যেন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করতে পারি।

এসআই/

spot_img
spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ প্রকাশিত

spot_img