সাইফুর রহমান শিহাব, জবি: সারাদেশে চলমান তীব্র দাবদাহে মানুষ যখন খুঁজে বেড়ায় একটুখানি স্বস্তির জায়গা তখন পুরান ঢাকার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজনের কাছে এক চিলতে সুখের জায়গা যেনো ভিক্টোরিয়া পার্ক। তাছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীদের কাছে জবির সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাস অন্যতম একটা স্বস্তির জায়গা।
পুরান ঢাকার বুকে স্ব গৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অন্যতম স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সবুজে ঘেরা এই নয় একরের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা এই তীব্র গরমে তাদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। ক্যাম্পাস ছোট হওয়াতে শিক্ষার্থীদের একটা অংশ সব সময় ভিড় জমায় ভিক্টোরিয়া পার্কে। জবি ক্যাম্পাস ও ভিক্টোরিয়া পার্কের এই সবুজায়ন যেন তীব্র দাবদাহে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিচ্ছে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন মানুষের মাঝে।
বৃহস্পতিবার (২ মে) বিশ্ববিদ্যালয়ের জবি ক্যাম্পাস ও ভিক্টোরিয়া পার্কে পরিদর্শন করে শিক্ষার্থী এবং মানুষজনের কাছে থেকে এমনি বার্তা পাওয়া যায়।
ভিক্টোরিয়া পার্কের আশেপাশে প্রায় ১৪টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষে অবসাদ, ক্লান্তি দুর করতে এই সবুজে ঘেরা এক টুকরো জায়গাকেই বেছে নেন শিক্ষার্থীরা।
এছাড়াও ‘যদি হাঁটুন দুবেলা, থাকবে না রোগের জ্বালা’—এই স্লোগানটি দেখা যায় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া পার্কের ভিতরে। এখানে মানুষ প্রতিনিয়ত সকাল ও বিকাল দুই বেলা হাঁটতে আসে। নাগরিক জীবনের বাস্তবতার ক্লান্তি ও অবসাদ কাটাতে একটু স্বস্তির সন্ধানে পার্কে আসে। এটিই পুরান ঢাকার একমাত্র পার্ক যেখানে মানুষ হাঁটতে আসে।
পার্কের চারদিকে গড়ে উঠা প্রায় অর্ধশত ভাসমান দোকানীরা তাদের দোকান খুলেন। চা, ফলমূল, আখের রস, ঝালমুড়ি, আইসক্রিমের দোকানের পাশাপাশি পার্কে থাকে স্বাস্থ্যবিষয়ক বুথ। ওজন মাপা, রক্তচাপ মাপা, রক্তের গ্রুপ নির্ণয়সহ বিভিন্ন সুযোগ থাকে পার্কে।
এর আগে সরেজমিনে দেখা যায়, তীব্র তাপদাহের মধ্যে যখন গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়, তখন পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বাইরে ভিক্টোরিয়া পার্কে বসে নির্বিঘ্নে সময় পার করছেন।

অভিভাবকদের অনেকে জানিয়েছেন, ‘পুরান ঢাকার মতো জায়গায় যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছোট হওয়ায় ভিতরে বসার অনুমতি নেই, তাই আমরা এই ভিক্টোরিয়া পার্কে অবস্থান নিয়েছি। এই জায়গাটাতে যেমন সবুজ বনায়নে ভরপুর আশেপাশে এমন কোনো আর জায়গা নেই। তাই এখানে বসে তীব্র তাপের প্রখরতা থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারছি।’
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮ শতকের শেষের দিকে এখানে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল। এই ক্লাবকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছিল আন্টাঘর। আর বিলিয়ার্ড বলকে অভিহিত করা হত আন্টা নামে। সেখানেই ছিল একটি ময়দান। ১৮৫৮ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানেই একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। এরপর থেকেই এই স্থানটির নাম হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। সিপাহী বিদ্রোহের (১৮৫৭ সাল) পর একটি প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ শাসকরা অনেক সিপাহীকে ফাঁসি দেয়। তাদের লাশ সেই ময়দানের বিভিন্ন গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ১৯৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮তম আবর্তনের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একটি ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়। পুরান ঢাকার বুকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অবস্থিত। একেতো ঢাকা প্রচণ্ড জনবহুল শহর, তার উপর পুরান ঢাকা আরো অনেক বেশি গিঞ্জি। এই তীব্র দাবদাহে এখানে হাটা চলাই দায়, ঠিক সেখানে ভিক্টোরিয়া পার্কের এই ছায়া ঘেরা অংশটুকু একটু স্বস্তির পরশ দিয়ে যায়। পাশাপাশি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ছোট ক্যাম্পাসটুকু আরেক প্রশান্তির জায়গা। তীব্র গরমে হাসঁফাস করার সময়, জগন্নাথের শান্ত চত্ত্বর, কাঁঠালতলাসহ অন্যান্য সবুজঘেরা জায়গা আমাদের মত শিক্ষার্থীদের জন্য স্বস্তি নিয়ে আসে। তীব্র দাবদাহে যখন ক্লাস করে ক্লান্ত হই, তখন ভিক্টোরিয়া পার্ক বা জবির ক্যাম্পাস আমাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে আসে, সেখানে কিছুক্ষণ বসলে ছায়া ঘেরা পরিবেশ আমাদের ক্লান্তি দূর করে, কিছুটা প্রশান্ত করে। এই ভিক্টোরিয়া পার্ক আর ক্যাম্পাস আমাদের মত শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষের জন্য তীব্র দাবদাহে এক টুকরো প্রশান্তি জায়গা।
পুরান ঢাকার নারিন্দার বাসিন্দা আশফাক উদ্দিন বলেন, এই যান্ত্রিক শহরের মধ্যে পার্কটির সবুজ পরিবেশ আমাদের কিছুটা হলেও সজীবতা দেয়। বিকালে পাখির ডাকও প্রকৃতি প্রেমীদের মন ছুঁয়ে যায়৷ যখনই সুযোগ পাই বন্ধুবান্ধব মিলে আসি এখানে। গাছপালা বেষ্টিত এমন জায়গা শহরে খুব কমই থাকে। এই তীব্র গরমে মানুষ এখানে প্রতিনিয়ত শান্তির ছোঁয়া খুঁজে পাচ্ছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার বলেন, পুরান ঢাকায় আমরা যারা থাকি তারা বেশিরভাগ সময় ক্যাম্পাসে আড্ডা দিই। কারণ ক্যাম্পাসে গাছপালা থাকায় এখানে বসতে ভালো লাগে। প্রকৃতির স্নিগ্ধ বাতাসে একটু হলেও সজীবতার ছোঁয়া পাই। তাছাড়া অনেক সময় ক্লাস শেষে সময় পেলে মাঝেমধ্যে আমরা বান্ধবীরা বাহাদুর শাহ পার্কে যাই। ঐখানেও একটা প্রশান্তি লাগে পার্কে গাছপালার ছায়া থাকায়। পরিবেশ খুব নির্মল না হলেও পুরান ঢাকার মানুষের একটা আত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান পার্কটির সাথে। আর এই তীব্র তাপদাহে আমরা পার্কে গাছের ছায়ায় বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিই। নানা শ্রেণি পেশার মানুষ এখানে আসে। সবার কাছেই এই জায়গাটা ভালো লাগে।
এসআই/