আকবর আলী রাতুল: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পেরোলেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্বাধীনতা স্মারকের নির্মাণকাজ আজও শেষ হয়নি। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নেই কোনো স্থায়ী শহীদ মিনার।
জানা গেছে, ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার তৃতীয় বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা স্মারকের বেদি নির্মাণের জন্য দ্বিতীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আবদুল জলিল মিয়াকে ২০ লাখ টাকা অনুদান দেয় জনতা ব্যাংক। পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে যোগ দেওয়া অধ্যাপক ড. এ. কে. এম. নুরুন্নবী স্থাপনাটির নির্মাণ কাজ শুরুর লক্ষ্যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ওই বছরের ২৮ নভেম্বর। কিন্তু কিছুদিন কাজ চলার পরে হঠাৎ করেই নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায় দীর্ঘদিনের জন্য। পরে স্বাধীনতা স্মারকের কাজ সম্পন্নের জন্য সরকারিভাবে ১ কোটি ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ পায় বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে ২০১৭ সালে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ যোগ দিয়ে ওই বছরই পুনরায় স্বাধীনতা স্মারকের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে সে সময়েও কাজ শেষ না হওয়ার আগেই আবার বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণকাজ। তাঁর মেয়াদ শেষে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ ২০২১ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করলেও এখন পর্যন্ত তিনি স্বাধীনতা স্মারকের নির্মাণকাজ পুনরায় শুরুর কোনো পদক্ষেপ নেননি।
তবে বর্তমানে স্থাপনাটির নির্মাণ কাজে তিনটি স্তম্ভ দাঁড় করানোসহ কিছু কাজ হলেও করা হয়নি স্তম্ভের মূল কাঠামোতে পোড়ামাটির কারুকার্য শোভিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি নির্মাণসহ অন্যান্য শিল্পকর্ম। এ ছাড়াও মেঝেতে বসানো হয়নি মার্বেল পাথর, দেয়ালে নির্মিত হয়নি টাইলস দিয়ে নির্মিত প্রতিকৃতি। তা ছাড়াও স্তম্ভগুলোতে যত্নের অভাবে শ্যাওলা পড়ে বর্ণহীন ও দৃষ্টিকটু হয়ে আছে।
পাশাপাশি প্রশাসনের যথাযথ নজরদারি না থাকায় সেখানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বিভিন্ন অসামাজিক কার্যক্রম। বিকাল গড়ালেই টোকাই ও বহিরাগতদের আড্ডাখানায় রূপ নেয় স্থানটি। যা নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এমন অযত্ন, অব্যবস্থাপনার ফলে দিনদিন মর্যাদা হারাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ স্থাপনাটি।
অপরদিকে অসম্পূর্ণ স্বাধীনতা স্মারকটির সামনেই জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনার। প্রতিষ্ঠার পরপর প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কাপড় দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করে শ্রদ্ধা জানানো হতো। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাপড় দিয়ে বানানো শহীদ মিনারটি দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে ২০১২ সালে তড়িঘড়ি করে কংক্রিটের অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় সড়কের পূর্ব দিকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরদারির অভাবে এ স্থাপনাটিও শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের আড্ডার আসরে পরিণত হয়েছে এবং প্রতিনিয়তই ঘটছে জুতা পরে মিনারে বসে থাকার মতো দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা স্মারকের কাজ বন্ধ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী মো. শাহরিয়ার আকিফ বলেন, স্বাধীনতা স্মারকের নির্মাণকাজটি বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতাধীন ছিল। অনিয়মের অভিযোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজটি বন্ধ রেখে তদন্ত করছে। তাই বর্তমানে কাজটি স্থগিত রয়েছে।
পাশাপাশি প্রতিষ্ঠার এতদিন পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী শহীদ মিনার কেন নির্মিত হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৫/১৬ বছরে কোনো উপাচার্য মহোদয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান তৈরির উদ্যোগ নেননি। মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া সরকার কোনো নতুন স্থাপনা নির্মাণে টাকা দেয় না। ফলে স্থায়ী শহীদ মিনারের জন্য একাধিকবার টাকা চাওয়া হলেও আমাদেরকে আগে মাস্টারপ্ল্যান করতে বলা হয়েছে। বর্তমান ভিসি মহোদয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। দেখা যাক কী হয়!
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহনা আক্তার বলেন, এটি সত্যিই অত্যন্ত দুঃখজনক যে নারী জাগরণের অগ্রদুত মহীয়সী বেগম রোকেয়ার নামাঙ্কিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো স্থায়ী শহীদ মিনার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের স্মরণার্থে কোনো পরিপূর্ণ স্থাপনা নেই। ৭৫ একরের সবুজে ঘেরা এ প্রাঙ্গণের সৌন্দর্য আরও বাড়াতে এবং শিক্ষার্থীসহ বহিরাগত পর্যটকদের বায়ান্নর রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলন ও দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে স্বাধীনতা স্মারক ও স্থায়ী শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ সমাপ্তিতে সত্বর পদক্ষেপ নিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী লিমা বলেন, শহীদ মিনার ও স্বাধীনতা স্মারক আমাদের বাঙালি জাতির পরিচয়বাহী। শহীদ মিনার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপদানের কষ্টার্জিত ইতিহাস। আর স্মারক আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারীদের স্মৃতি বহন করে। ফলে এ ধরনের স্থাপনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও বহিরাগত ব্যক্তিবর্গের জুতা পরে উঠে বসে আড্ডা দেওয়া আমাদের জন্য অপমানজনক। তাই আমাদের জাতীয় সম্মান রক্ষার্থেই কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।
এসআই/
মন্তব্য করুন