শাকিল শাহরিয়ার: বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি গোপালগঞ্জে মাত্র ৫৫ একরের ক্যাম্পাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)। এই স্বল্প পরিসরের মধ্যে প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থী, ৩৫০ জন শিক্ষক এবং ৬’শর অধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদচারণা এই ক্যাম্পাসে। আয়তনে ছোট হলেও প্রতিনিয়তই সৃষ্টি হয় নতুন নতুন সব স্মৃতির গল্প।
ক্যাম্পাস ছোট হওয়ায় পরিচিত মুখগুলোর সাথে সাক্ষাৎ ঘটে নিয়মিত; প্রাণচঞ্চল থাকে প্রিয় ক্যাম্পাস। এরই মাঝে এসেছে রহমতের মাস রমজান। রমজানের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি ধাপ হলো সাহরি ও ইফতার। তবে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ইফতার নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখান। রমজানে প্রতিদিন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মাঝে ইফতার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ছোট বড় ইফতারের আসরে মুখরিত হয়ে উঠে বশেমুরবিপ্রবি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় মাঠ, লেকপাড়, মসজিদ মাঠ, প্রশাসনিক ভবনের প্রাঙ্গণ ছাড়াও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় জমে উঠে ইফতার উৎসব। এর মধ্যে সব থেকে বেশি প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি লক্ষ্য করা কেন্দ্রীয় মাঠে। সব মিলিয়ে এ যেন ভ্রাতৃত্বের অনন্য এক বন্ধন।
ক্যাম্পাসে সিনিয়র-জুনিয়র সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির মেলবন্ধনে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে ইফতার আয়োজন। রোজা শুধু মুসলমান ধর্মের ইবাদত হলেও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে থাকেন অন্য ধর্মাবলম্বী বন্ধুরাও।
বিকাল গড়িয়ে ইফতারের সময় যতো কাছাকাছি আসে ধীরে ধীরে ততোই জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। এরপর বন্ধুরা মিলে বাহারী পদের খাবার নিয়ে সাজাই ইফতারের আসর। এখানে সবার উদ্দেশ্য থাকে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দঘন পরিবেশে ইফতার করা। তাই এখানে ইফতারের আয়োজনে কী থাকছে সেটা একেবারেই গৌণ বিষয়।
ইফতারের সময় হলেই ক্যাম্পাসে ছোট ছোট দল তাদের ইফতার সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ ইফতার সাজানোর পাশাপাশি চলে আড্ডা-গল্প, হাসি ঠাট্টা। সচরাচর তাদের ইফতারির মধ্যে থাকে মুড়ি, আলুর চপ, পেঁয়াজু, ডিমের চপ, বেগুনি, জিলাপি,খেজুর, জুস, শরবতসহ নানা রকমের মৌসুমি ফলফলাদি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী তাদের বন্ধু, সিনিয়র বা জুনিয়রদেরকে নিয়ে আয়োজন করে ইফতারির। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও আয়োজন করা হয় ইফতারের। শিক্ষার্থীদের ছোট বড় অসংখ্য ইফতারের আয়োজনে মুখর হয়ে ওঠে বিকালের বশেমুরবিপ্রবি ক্যাম্পাস। এ যেন এক আত্মিক মিলনমেলা।
ক্যাম্পাসে ইফতারের অনুভূতি জানিয়ে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ইকরামুল ইসলাম বলেন, ‘বন্ধুরা সবাই একসাথে ইফতার করার জন্য পরিবার থেকে দূরে থাকার যে কষ্ট তা কিছুটা হলেও কম হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে এ যেন আমার আরেকটি পরিবার।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থী ইনশিরা ইশতাক বলেন, ‘রমজানের মর্যাদা বজায় রাখতে সকলের মাঝে সম্প্রীতি প্রয়োজন। সব শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ-জাত বিভেদ ভুলে গিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে ইফতারে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে প্রাণের বশেমুরবিপ্রবি ক্যাম্পাস। সাম্প্রদায়িক শক্তির মুখে একমুঠো ছাই ফেলে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রাঙ্গণে। চোখ বুলিয়ে যাওয়ার মতো অনাবিল দৃশ্য ভুলবার নয়। এভাবেই জমকালো ইফতারের মাধ্যমেই বন্ধুত্বের বন্ধন হোক অটুট, সেই প্রত্যাশা।’
গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ফরহাদ জানান, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পরিবার ছাড়া গোপালগঞ্জে থাকে। ক্যাম্পাস খোলা থাকায় পরিবারের সঙ্গে একত্রে ইফতার করাটাও হচ্ছে না। এ জন্য আমরা যারা বন্ধু-বান্ধব আছি, তারা সব সময় একসঙ্গে আমাদের পরিবারের মতো ক্যাম্পাসে ইফতার করার চেষ্টা করি।’
কৃষি বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী রাহাদ বলেন, ‘ইফতারের সময়ে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে পরিবেশ দেখে বিমোহিত হয়ে গেলাম। সবাই দলে দলে ইফতার নিয়ে বসে আছে। এ সৌন্দর্য অন্য রকম। আমরাও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ইফতার তৈরি করা নিয়ে। ইফতার পরিবেশন ও শরবত বানানোর সময় বারবার মনে হচ্ছিল যেন নিজের পরিবারের সঙ্গেই আছি। বাড়ির বাইরে রোজা ও ইফতারের এই প্রথম অভিজ্ঞতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ইফতারের এই সুন্দর আয়োজন সত্যি মনোমুগ্ধকর ও আনন্দের। পরিবারের সঙ্গে ইফতার খুব মিস করছি, তবে বন্ধুদের সঙ্গে ইফতারও খুব উপভোগ করছি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে বন্ধুরা মিলে ইফতার করার এই মুহূর্তটা খুব মিস করব।’
সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী সৌম্য দীপ্ত বলেন, ‘ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার পরও সহপাঠী এবং সিনিয়র ভাই-বোনদের থেকে ইফতারের দাওয়াত পেয়ে খুব ভালো লাগে। একসঙ্গে বসে ইফতার করার মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্র ফুটে ওঠে।’
আদিবাসী শিক্ষার্থী মংখেয় চিং মারমা বলেন, ‘রমজান মাসে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকায় ক্যাম্পাসে সময় কাটছে। অন্য ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও সহপাঠী, সিনিয়র বড় ভাই-বোনদের থেকে প্রতিদিনই ইফতারের দাওয়াত পাই। এ যেন ভ্রাতৃত্বের এক বন্ধন। অসাম্প্রদায়িকতার এক দৃষ্টান্তমূলক প্রতিফলন। এবারের রমজানে অনেক ইফতারের দাওয়াত পেয়েছি।’
প্রতিদিনই ক্যাম্পাসে কোনো না কোনো ইফতার আয়োজন লেগেই থাকে। বিভাগের সিনিয়র- জুনিয়র, ব্যাচমেট, জেলা ছাত্র কল্যাণ ছাড়াও অনেক মাধ্যমে ইফতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এভাবে পুরো রমজান মাসই একের পর এক সংগঠনের ইফতার আয়োজন চলতেই থাকে।
এতে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। ইফতারের সময় ক্যাম্পাসে ইফতারের মাধ্যমে যেন নিজের পরিবারের অভাবটা পূরণ হয়। বশেমুরবিপ্রবির ইফতার আয়োজনের সব থেকে বড় সৌন্দর্য হলো অসাম্প্রদায়িকতা। তরুণ ছাত্র সমাজের মাঝে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ এবং ধর্মীয় গোঁড়ামী দূর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে এই ইফতার আয়োজন এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
এসআই/
মন্তব্য করুন