বাকৃবি প্রতিনিধি:
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন উচ্চ ফলনশীল বাউ মিষ্টি আলু-৫। এই জাতটি উদ্ভাবন করেন কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. এ.বি.এম. আরিফ হাসান খান রবিন এবং তার গবেষক দল।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় জেনেটিক্স অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগের মাঠ গবেষণাগারে এই জাতের উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে ১০০ জন কৃষকের মাঝে ১০০টি করে মিষ্টি আলুর চারা বিতরণ করা হয়, যা ১ শতক জমির জন্য পর্যাপ্ত।
প্রধান গবেষক ড. এ.বি.এম. আরিফ হাসান খান রবিন বলেন, “আমাদের লক্ষ্য কৃষকদের মধ্যে এই উন্নত জাতটি দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া। বর্তমানে কোনো কৃষক চাইলে আমরা আরও ২০ হাজার চারা বিতরণ করতে পারবো এবং পরবর্তীতে এর চেয়ে বেশি সংখ্যক চারা দেওয়া সম্ভব হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষকরা উন্নত জাতের মিষ্টি আলু চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন।”
জানা যায়, বাউ মিষ্টি আলু ৫ একটি উচ্চ ফলনশীল জাত এবং এটি সারা বাংলাদেশে চাষযোগ্য। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্করা জাতীয় ফসল। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ আছে, যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক এবং এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও বিদ্যমান। এছাড়াও এতে ভিটামিন বি, সি, কে, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, এবং জিঙ্ক বিদ্যমান থাকায় বাউ মিষ্টি আলু ৫ অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন। এতে অ্যান্থোসায়ানিন ও ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদানও আছে। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপযোগী।
বাউ মিষ্টি আলু ৫ স্বল্প জীবনকালীন, ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। প্রতি কন্দের গড় ওজন ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম হয় এবং দেরিতে ফসল ঘরে তুললে কন্দের ওজন আরও বেশি হতে পারে। প্রতি গাছে চার থেকে ছয়টি বা তার চেয়ে বেশি মিষ্টি আলু হতে পারে। এতে গ্লুকোজের পরিমাণ প্রতি ১০০ গ্রামে ৭.৮ গ্রাম। কন্দের রং লালচে গোলাপী এবং আকর্ষণীয়। কন্দে শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ প্রায় ৩০%। প্রতি ১০০ গ্রাম কন্দে ০.১৫ মিলিগ্রাম ক্যারোটিনয়েড, ৩.৯ মিলিগ্রাম অ্যান্থোসায়ানিন এবং ১৫ মিলিগ্রাম ফ্যানোলিক উপাদান পাওয়া যায়।
অনুষ্ঠানে কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রাশেদ হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. কে. ফজলুল হক ভূঁইয়া। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাম্মাদুর রহমান, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ, ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল হক, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. হেলাল উদ্দীন, ইন্টারন্যাশনাল পটেটো সেন্টারের (সিআইপি) কান্ট্রি প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ড. দেবাশীষ চন্দ এবং প্রধান গবেষক ও কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. এ.বি.এম. আরিফ হাসান খান রবিনসহ শতাধিক কৃষক।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. কে. ফজলুল হক ভূঁইয়া কৃষকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “বাকৃবির গবেষণা কৃষকদের সমস্যা সমাধানে নিবেদিত। কম খরচে বেশি পুষ্টি ও লাভ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাকৃবি গবেষকরা উচ্চ ফলনশীল বাউ মিষ্টি আলু ৫ জাত উদ্ভাবন করেছেন। এই জাতের মিষ্টি আলু কৃষকের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন এবং আর্থিক উন্নতির পথ সুগম করবে।”
ড. ফজলুল হক আরও বলেন, “কৃষি বিষয়ক যেকোনো গবেষণায় কৃষকের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকদের মাধ্যমেই গবেষণা মূল্যায়িত হয়, কারণ আমাদের গবেষণা প্রধানত কৃষকদের জন্য। আজ বাউ মিষ্টি আলু ৫ এর চারা বিতরণের মাধ্যমে কৃষকরা এই গবেষণায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। যদি আপনারা এই চারা থেকে সফলভাবে আলু উৎপাদন করতে পারেন, তবে জাতটি আপনাদের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়বে এবং এর পুষ্টি সারা দেশে পৌঁছাবে।”
তিনি আরও বলেন, “স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে দুধ ও ডিমের পাশাপাশি মিষ্টি আলু বিতরণ করা উচিত, যা পুষ্টি চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে। কৃষক ও খামারিদের উপকৃত করবে এমন গবেষণার সংখ্যা বাড়ানো দরকার, যাতে দেশের কৃষক ও জাতি আর্থিকভাবে লাভবান হয়।”
বাউ মিষ্টি আলু ৫ এর চারা পাওয়ার পর কৃষক আব্দুল করিম বলেন, “আমি অনেক দিন ধরে আলু চাষ করছি, কিন্তু এই বাউ মিষ্টি আলু ৫ জাত সম্পর্কে প্রথম শুনলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই উন্নত জাতের চারা পেয়ে খুবই খুশি। এটি কম খরচে চাষ করা যায় বলে শুনেছি এবং এর পুষ্টিগুণও বেশি। আমরা যদি এই আলু থেকে ভালো ফলন পাই, তাহলে আমাদের এলাকায় এই জাতটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আশা করি, এই চাষাবাদ থেকে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হবো এবং পরিবারের পুষ্টি চাহিদাও পূরণ হবে।”
/ইএইচ