এডুকেশন টাইমস ডেস্ক: নিজের চেষ্টা আর অদম্য ইচ্ছা যে একজনকে সফল করতে পারে তার আরও একটি উদাহরণ আসাদুজ্জামান নুর। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ১৬তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলে সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। যদিও একসময় পড়ার বই কেনার মতো টাকা তার কাছে ছিল না। বন্ধুর কাছে বই নিয়ে পড়াশোনা করে তিনি এ ফলাফল করেন। তিনি ২০১৭-১৮ বর্ষের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পড়ছেন স্নাতকোত্তর।
পঞ্চগড়ের সদর উপজেলার মৃত মো. নুর বাদশার দ্বিতীয় সন্তান নুর। এসএসসিতে জিপিএ ৫ এবং এইচএসসিতে ৪.৩৩ জিপিএ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০১৭ সালে ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ইবির আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন। ২০১২ সালে নুর বাবাকে হারান। সবেমাত্র এসএসসি পাস করেছেন। তখন থেকেই মা মোছা. রশিদা পারভীনের অনুপ্রেরণায় এই পর্যায়ে আসা নুরের।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর শুরুর দিকে পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী ছিলাম না। করোনার সময় জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। অনিশ্চয়তার জীবনে নিজেকে বদলানোর প্রয়াসে ধর্ম পালন এবং পড়াশোনায় মনোযাগী হই।
বাবার মৃত্যুর পর আর্থিক সংকটে পড়েন নুর। তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র। মাত্র ৬ শতক জমির ওপর ভিটেমাটি ছিল একমাত্র সহায় সম্বল। তবে হাল না ছেড়ে লেগে যান কঠিন জীবন যুদ্ধে। মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অনুপ্রেরণায় ১৬তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) নিয়োগ পরীক্ষায় ৪০তম হন। বই কেনার টাকা না থাকায় বন্ধুর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ে প্রথমবারের পরীক্ষাতেই নুর পৌঁছে যান এ সাফল্যের শিখরে। সুপারিপ্রাপ্ত হন সহকারী জজ পদে। এ পেশাতেই একজন ন্যায় বিচারক হতে চান তিনি।
করোনায় দীর্ঘ সময় অর্থ সংকটের কারণে অন্যের দোকানে কর্মচারী হিসেবেও কাজ করেছেন। করোনা কাটলেও কাটছিল না অনিশ্চয়তা। অনেকের কাছে সহযোগিতা চাইলেও মিলেনি সাড়া। তবে প্রিয়জনদের কাছ থেকে পেয়েছেন সহযোগিতা। বাবা মারা যাওয়ায় মা তাকে সাহস যোগাতেন। মায়ের জন্যই এ সফলতা এসেছে বলে জানান নুর।
আসাদুজ্জামান নুর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রথম দুই বছর ‘সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট’র সহযোগিতায় পার করেছি। করোনা প্রকোপের পর আর্থিক সংকটে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। ঠিক ওই মুহূর্তে ‘পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ’ গ্রুপের খোঁজ পাই। সংস্থাটি আমাকে আর্থিক নিরসনের লক্ষ্যে পৌঁছতে সহযোগিতা করেছে। এ কারণে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারি। সংস্থাটির প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) পরীক্ষায় অংশ নিতে বন্ধু হোসনে মোবারক সাগর ও নোসাইব মোহাম্মদ নাজ্জাসির বই নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। বিজেএসসির প্রিলি হতে লিখিত পরীক্ষার পুরোটা সময় তাদের বই পড়েছি। কারণ আমার বই কেনার কোনো সামর্থ্য ছিল না।
জুডিশিয়ারীর দিক নির্দেশনায় আমাকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন সাকিব আহমেদ ইমন ভাই। তিনি ছিলেন ১৫তম বিজেএসসি পরীক্ষায় সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত। তাছাড়া ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরাও আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করে অনুপ্রাণিত করেছেন।
বিচারক হওয়ার আগে থেকেই স্বপ্ন ছিল কী না জানতে চাইলে নুর জানান, আগে থেকে বিচারক হওয়ার স্বপ্ন না থাকলেও পরবর্তীতে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে থাকি। তবে আমার বাবা চাইতেন আমাকে আইনে পড়াবেন। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর রহমতে ১৬তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। ন্যায় বিচারক হতে চাই। কেননা ন্যায় বিচারকের সম্মান দুনিয়া ও আখেরাতেও। কেয়ামতের দিন আল্লাহ যেই সাত শ্রেণির মানুষকে তার আরশের ছায়ায় আশ্রয় দিবেন, তাদের মধ্যে প্রথম হলো ন্যায় বিচারক। তাই সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আমার দ্বারা অন্যায়ভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সবাই উপকৃত হন।
মা রশিদা পারভীন বলেন, আমার বিশ্বাস ছিল আমার ছেলে বড় হয়ে কিছু একটা হবে। তাই কঠিন দরিদ্রতার ভেতর ছেলেকে কিছু দিতে না পারলেও চেষ্টা করেছি সেলাই মেশিনের আয়ে তাকে পড়াশোনা করানোর। সে যে সাফল্যের আলোর মুখ দেখেছে এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া। সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।
আইন শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো পরামর্শ আছে কী না এমন প্রশ্নের উত্তরে আসাদুজ্জামান নুর বলেন, আমার অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট খুব ভালো ছিল না। আমি জুডিশিয়ারি ও অ্যাডভোকেসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে বেশি ভাবতাম। পড়ালেখা শেষ করেই অনেকে চাকরির প্রস্তুতি নেয়। এটা আমার চোখে কঠিন মনে হয়। কারণ, অ্যাকাডেমিক পাঠ শেষ হলেই শুরু হয় অর্থনৈতিক চাপ। এ কারণে তখন চাকরির প্রস্তুতি সেভাবে নেওয়া যায় না। যারা আইন পেশায় স্বপ্ন দেখছেন তাদের প্রতি আমার পরামর্শ অনার্সের শুরু থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবেন। পড়াশোনায় ব্যাপক মনোযোগী হতে হবে। আমরা সেদিন হলে বন্ধুদের বলেছিলাম, ‘হলে প্রথম বারই হতে হবে, যদি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে ফার্স্ট হতে হবে’। নতুনদের এরকম একটি ইচ্ছেশক্তি থাকতে হবে। তাহলেই স্বপ্ন জয় সম্ভব।
ইবির এই শিক্ষার্থী বলেন, আজ আমার এই অর্জনে যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন, সে মানুষটা আমার বাবা। সেই মানুষটা আজ আর নেই। এটাই আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ। এছাড়া আমার কোনো দুঃখ নেই।
পড়াশোনার বিষয়ে নূর বলেন, আমি ফজরের নামাজ পড়ে পড়াশুনা শুরু করতাম। যতক্ষণ ক্লান্ত না হতাম ততক্ষণ পড়ার চেষ্টা করতাম। সব সময় চেষ্টা করেছি বুঝে পড়ার। একটা বিষয় কয়েকবার পড়ার চেষ্টা করেছি। সর্বোপরি মায়ের ইচ্ছে পূরণে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আর আল্লাহ কাছে সাহায্য চেয়েছি। সবার দোয়া আর নিজের প্রচেষ্টার সম্মিলিত প্রয়াস আজকের এই সফলতা।
নুরের সফলতায় উচ্ছ্বসিত সহপাঠী, শিক্ষক ও বড় ভাইয়েরা।
এসআই/
মন্তব্য করুন