ফরহাদ হোসাইন হিমু, কুবি: সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) উপাচার্য এবং শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্বের ঘটনা শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় হাতাহাতিতে। গত ২৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনে প্রবেশকালে উপাচার্যের সাথের সাথে শিক্ষক সমিতির এমন হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এনিয়ে দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও থানায় মামলার ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে গত মার্চ মাস থেকেই সাত দাবিতে আন্দোলন করে আসছে শিক্ষক সমিতি, সব রকম একাডেমিক কার্যক্রমও বর্জন করেছে।
এমন পরিস্থিতি গত ৩০ এপ্রিল ৯৩তম জরুরি সিন্ডিকেট সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে সেশনজটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত ২৯ এপ্রিল শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানান, উপাচার্যের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত সকল কার্যক্রম বর্জন করা হলো।
এর আগে উপাচার্য শিক্ষক সমিতির সাত দফা দাবি মেনে না নেয়ায় তিন দফায় শ্রেণি কার্যক্রম বর্জন করেন শিক্ষকরা। প্রথম দফায় ১৩ ও ১৪ মার্চ শ্রেণি কার্যক্রম বর্জন করেন। পরবর্তীতে দাবি আদায় না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় ১৯ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ এবং তৃতীয় দফায় ২১ এপ্রিল থেকে ২৩ এপ্রিল শ্রেণি কার্যক্রম বর্জন করে।
শ্রেণি কার্যক্রম থেকে শিক্ষকরা বিরত থাকায় মিডটার্ম, এসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশন বারবার পেছানো হয়। ফলে ইতোমধ্যে অনেক বিভাগের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে (সম্ভাব্য তারিখ ২৮ এপ্রিল) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। শিক্ষকদের শ্রেণি কার্যক্রম বর্জনে মিডটার্ম, এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন পিছিয়ে যায়। সেই সাথে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষাও পিছিয়ে যায়। এতে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ ছাড়াও ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগ, বাংলা বিভাগ, মার্কেটিং বিভাগ, লোকপ্রশাসনসহ বেশ কয়েকটি বিভাগে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, পরীক্ষা হবে কি-না এ বিষয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্ব কবে শেষ হবে? কবে ক্যাম্পাস স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে?
শিক্ষার্থীরা বলছেন, সেশনজটে পড়লে ক্যারিয়ারের ক্ষতি। শিক্ষার্থীদের ক্ষতির দায় কে নিবেন?
এদিকে গত বুধবার (১ মে) বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে মানববন্ধন করেছে শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী দিতি রাণী সেন কণা বলেন, ‘করোনাকালে আমাদের একাডেমিক অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় আমরা আমরা সেশনজটে পড়ব। হল বন্ধ করার যৌক্তিকতা দেখি না। আমার বাসা উত্তরবঙ্গে, এক সপ্তাহ আগে আসছি। বাসায় যাওয়ার আসা করতে ৩ হাজার টাকা লাগে। হুট করে আমি এত টাকা কোথায় পাব। এখন বাসায় গেলে আমার টিউশন দুটোও হারাবো।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সামিউল ইসলাম সজিব বলেন, ‘গতানুগতিক ধারায় দেখে আসছি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে। কিন্তু এই প্রথম দেখছি কোথাও শিক্ষকরা তাদের স্বার্থ হাসিলে আন্দোলনে নেমেছে। শিক্ষক সমিতির ক্লাস বর্জনের ফলে আমাদের এখনো মিড, প্রেজেন্টেশন বাকি। সেমিস্টার ফাইনাল পিছিয়ে গেছে। উনাদের এসব কর্মকাণ্ডে আমাদের যদি সেশনজট হয় তাহলে এই দায়ভার কে নেবে? শিক্ষক সমিতি ও উপাচার্যের দ্বন্দ্বে কেন আমার সাধারণ শিক্ষার্থীরাই বলি হব?’
মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী পাভেল রানা বলেন, ‘করোনার কারণে আমরা একাডেমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন আবার শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা নিচ্ছে না। এভাবে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষক সমিতি ও উপাচার্যের মধ্যে যে ঝামেলা সেটা তারা আলোচনা করে সমাধান করুক। আমাদের কেন জিম্মি করে হচ্ছে? আমরা স্বাভাবিক ক্লাস কার্যক্রম চাই। দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে চাই।’
বাংলা বিভাগের তাওহীদ হোসেন সানি বলেন, করোনা মহামারীর কারণে আমাদের শিক্ষা জীবন অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার ওপর এখন শিক্ষকদের ক্লাস পরীক্ষা বয়কটের সিদ্ধান্ত যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। ঈদের পর আমাদের স্নাতকোত্তর ১ম সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা, কিন্তু ঈদের আগেও ক্লাস বয়কটের কারণে ক্লাস হয়নি, ঈদের পর এসেও ক্লাস হচ্ছে না। তাতে আমাদের কোর্সও শেষ হচ্ছে না, পরীক্ষায় বসতে পারছি না। আমাদের বয়সতো থেমে নেই।’
এ ব্যাপারে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ নূরুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘কয়েকটি বিভাগের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এবং মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হওয়ার কথা ছিল। বিভাগসমূহ চূড়ান্তভাবে আমাদেরকে সেমিস্টার ফাইনালের এখনো জানায়নি। বিভাগগুলো থেকে না জানালে আমি কিছু বলতে পারছি না। এই মাসে সেমিস্টার ফাইনাল নিয়ে অনেকগুলো প্রস্তাবনা ছিল। ডিপার্টমেন্টগুলে যদি এ ব্যাপারে আসে, তবে আমি পরীক্ষার জন্য সিদ্ধান্ত দিতে পারব।’
মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) শিক্ষক সমিতির ডাকা মানববন্ধনে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো: আবু তাহের বলেন, ‘উপাচার্যের পদত্যাগ কিংবা অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাসে ফিরব না। করোনার সময়ে আমরা শিক্ষার্থীদের দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছি। প্রয়োজনে আমরা বন্ধের দিনে ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ক্ষতি পূরণ করে দিব। এ ব্যাপারে আমরা শিক্ষকরা নিরলস পরিশ্রম করতে প্রস্তুত।’
শিক্ষকদের এমন সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ব্যাপারে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এসআই/
মন্তব্য করুন