বুটেক্স প্রতিনিধি: বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) ফ্যাক্টরি বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট আয়োজনে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রতি সেমিস্টারে বিভাগভিত্তিক একটি করে ভিজিট হওয়ার কথা থাকলেও নিয়মিত হচ্ছে না। এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা গেছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের বিভাগের কো-অর্ডিনেটরদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট আয়োজনে অনীহা ও সক্ষমতা নিয়ে অভিযোগ আনলেও শিক্ষকরা বলছেন ভিন্ন কথা।
বিভাগে শিক্ষক সংকট, একসঙ্গে বেশি শিক্ষার্থীর ইন্ডাস্ট্রি গ্রহণ না করা, বাজেট সংক্রান্ত জটিলতা, কেন্দ্রীয়ভাবে ভিজিটের প্রক্রিয়া না থাকা, বারবার চেষ্টার পরও ইন্ডাস্ট্রি গ্রহণ না করাসহ নানা অযুহাত দেখাচ্ছেন শিক্ষকরা।
জানা গেছে, বুটেক্সে বর্তমানে ১০টি বিভাগের আন্ডারে বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এখান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। প্রযুক্তির উন্নয়নের এ যুগে সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে টেক্সটাইল সেক্টর। এতে অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের অনেক কিছুই মিল পান না শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া সব বিষয়ে ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনের সুযোগও হয়ে উঠে না শিক্ষার্থীদের। এজন্য তাদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে মিল রেখে ব্যবহারিক জ্ঞানার্জন, টেক্সটাইলের আধুনিক বিষয়াদির সঙ্গে পরিচয়, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নিয়ে ধারণা নেওয়া এবং টেক্সটাইলের বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ে সম্যক ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতি সেমিস্টারে টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে শিক্ষার্থীদের বিভাগভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিটে নিয়ে যাওয়ার নিয়ম রয়েছে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিটের সমস্ত ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহন করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কিংবা ভাড়া করা যানবাহনে শিক্ষার্থীরা শ্রেণি কো-অর্নিনেটরের তত্ত্বাবধানে ভিজিটে যান। ফ্যাক্টরি নির্বাচন থেকে শুরু করে ট্যুরের যাবতীয় বিষয়াদি আয়োজন করে থাকেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কো-অর্ডিনেটর।
২০২৩ সালের ২৬ জুন বুটেক্স সাংবাদিক সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, বুটেক্সের ৪৪তম থেকে ৪৭তম ব্যাচের প্রতি বিভাগে সম্পন্ন হওয়া সেমিস্টার বিবেচনায় মোট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট হওয়ার কথা ২০২টি। কিন্তু বাস্তবে ভিজিট হয়েছে মাত্র ১০৬টি। ভিজিট আয়োজনের বিষয়টি অন্যান্য ব্যাচের ক্ষেত্রেও নিয়মমাফিক না হওয়ার চিত্র দেখা গেছে।
৪৬তম ব্যাচের শ্রেণি প্রতিনিধিদের থেকে জানা যায়, তাদের ব্যাচে প্রতি বিভাগে ছয়টি করে ভিজিট হওয়ার কথা থাকলেও প্রতি বিভাগে সবচেয়ে কম ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট হয়েছে। এসব বিভাগের মধ্যে রয়েছে- ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট, টেক্সটাইল ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন, ডাইস অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। এ বিভাগগুলোতে মাত্র দুটি করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট হয়েছে।
তাছাড়া ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং টেক্সটাইল মেশিনারি ডিজাইন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স বিভাগের তিনটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চারটি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের পাঁচটি।
এ বিষয়ে ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান বলেন, আমাদের ছয়টা সেমিস্টার শেষ হতে চললো। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট হয়েছে। আরেকটি হওয়ার আলোচনা চলছে। ইন্ডাস্ট্রি ভিজিট থেকে আমরা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির কর্ম পরিবেশ, বিভিন্ন প্রক্রিয়া, প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে ভালো ধারণা পাই, যা আমাদের জব সিলেকশনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
একই ব্যাচের অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আবিদ হাসান বলেন, উপাচার্য স্যারের ভাষ্যমতে আমাদের কমপক্ষে পাঁচটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট দরকার। নিটিং, উইভিং, স্পিনিং, ডাইয়িং এবং কম্পোজিট সম্পর্কে জানলে মোটামুটি প্রোডাকশন নিয়ে ভালো একটা আইডিয়া হবে আমাদের। তৃতীয় বর্ষ প্রায় শেষের দিকে, কিন্তু আমাদের এ পর্যন্ত মাত্র দুটি ভিজিট সম্পন্ন হয়েছে। সবাই ব্যাপারটি নিয়ে এত চিন্তিত থাকার পরও কেনো হচ্ছে না, তা আমাদের জানা নেই।
একই ব্যাচের ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সিয়াম পিবর জানান, আমাদের প্রথম ভিজিট হয় একটা কম্পোজিট ফ্যাক্টরিতে। সেখানে কাটিং সেকশন, ডায়িং সেকশন থেকে শুরু করে মোটামুটি সবকিছুই ছিল। আর দ্বিতীয় ভিজিটে আমাদের ইয়ার্ন-ফেব্রিক ডায়িং এবং প্রিন্টিংয়ের একটি ফ্যাক্টরি ভিজিটে নিয়ে যাওয়া হয়। করোনার কারণে আমাদের প্রথম বর্ষে কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট হয়নি। কম ভিজিট হওয়ার এটা একটি কারণ হতে পারে। তাছাড়া অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাও থাকতে পারে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েট প্রসেস ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের কো-অর্ডিনেটর শিক্ষক ইমরান হোসেন জানান, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরে যেসব সমস্যা হয়, তার মধ্যে প্রথম সমস্যা হলো- ট্যুর ম্যানেজ করা। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে যদি কোনো পদ্ধতি থাকতো, তাহলে সুবিধা হতো। তাছাড়া ট্যুর থেকে এসে অনেক কাজ থাকে। আর্থিক ব্যাপারটাও আর একটু সহজ করা যেতে পারে। আবার পরিবেশগত কারণে অনেক সময় হয়ে উঠে না। এক সময় করোনার কারণে হয়নি, প্রচণ্ড গরমেও হয়ে উঠে না। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা একটা বিষয় জানা ছাড়াই ইন্ডাস্ট্রিতে দেখে আসলে অনেক সময় ফলপ্রসূ হয় না। এতে তাদের বুঝতে সমস্যা হয়।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষক সংকট আছে। একজন শিক্ষককে বারবার যাওয়া লাগে। ইন্টার ডিপার্টমেন্ট টিচার নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে, এ ব্যাপারটি সহজতর হতো। শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি আরও নানা ধরনের কাজ করা লাগে। ইন্ডাস্ট্রি ম্যানেজ করা কষ্ট হয়ে যায়, সময় সাপেক্ষ ব্যাপারও। আমার কাছে মনে হয়, প্রতি ছয় মাসে টুরের দরকার হয় না, বছরে একবার গেলেই হয়। আমরা ওয়েট প্রসেস বিভাগ সবসময় যে আমাদের বিভাগ সংক্রান্ত ইন্ডাস্ট্রিতে যেতে হবে, এমন তো নয়। যে সেমিস্টারে ফেব্রিক, ইয়ার্ন পড়ায়, ওই সেমিস্টারে সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিতে যাওয়া যেতে পারে।
ফেব্রিক ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের কো-অর্ডিনেটর শিক্ষক মো. মোহাদ্দেস হোসেন বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে বলেন, প্রতি সেমিস্টারে একটা করেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুর হওয়ার কথা। কিন্তু শিক্ষক সংকটের জন্য হয়ে উঠে না। কিছু শিক্ষক সংকট রয়েছে আমাদের, অনেকে বিদেশে অবস্থান করছেন। আমরা উইভিং, নিটিং ছাড়া করাই না। এতে করে ইন্ডাস্ট্রি পেতে সমস্যা হয়। প্রথম বর্ষে মূলত ফাইবার, পলিমার পড়ানো হয়। দেশে এ সংক্রান্ত ইন্ডাস্ট্রি খুব একটা নেই, যদি থাকতো তাহলে ভাল হতো।
তিনি আরও বলেন, ৪৬তম ব্যাচের প্রথম এক থেকে দেড় বছর করোনার জন্য ভিজিট হয়নি। তবে পরবর্তী ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত হচ্ছে। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে, বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে যোগাযোগ করার। আগে ইন্ডাস্ট্রিতে থাকা বড় ভাইদের বললেই হতো, কিন্তু এখন ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করা লাগে ট্যুরের জন্যে, রেসপন্স অনেক কম আসে। তাও চেষ্টা চলছে। অনেক সময় শেষ মুহুর্তে এসে ফ্যাক্টরি না করে দেয় অডিট বা অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে। অনেক সময় যখন আমরা যোগাযোগ করি তখন বিভাগের ৭০-৮০ জন শিক্ষার্থী সংখ্যা শুনলে তারা একটু ইতস্তত করেন। দুই ধাপে আসার জন্য বলেন। একই ব্যাচকে দুই ধাপে নেওয়ার নিয়ম নেই। এতে করে ইন্ডাস্ট্রি ম্যানেজ করা কঠিন হয়ে পরে। প্রতি সেমিস্টারে নিয়ে যাওয়া কঠিন হলেও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এসআই/
মন্তব্য করুন