spot_img

ছাত্র রাজনীতিতে বাকৃবিতে ঝ‌রেছে ১৬ প্রাণ, বিচার হয়নি একটিরও

এসম্পর্কিত আরো পড়ুন

বাকৃবি প্রতি‌নি‌ধি: কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার ব্রত নিয়ে ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে গড়ে উঠা দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি শিক্ষার অন্যতম সেরা বিদ্যাপিঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। দেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় ছাত্র রাজনীতিতে সরব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি।এখানে ছাত্র রাজনীতির নামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অকালেই ঝরে গেছে ১৬টি তাজা প্রাণ। আজ পর্যন্ত এর একটিরও বিচার হয়নি। এদের সবাই একজন দক্ষ কৃষিবিদ হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই এ সবুজ ক্যাম্পাসে পা রেখেছিলেন। সেই সাথে মা-বাবাও ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় বুক বাঁধতেন। কিন্তু লেজুড়বৃত্তিক দলীয় ছাত্র রাজনীতির করাল গ্রাসে হারিয়ে গেছে সব স্বপ্ন। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর স্বাধীন দেশে ছাত্র রাজনীতির নামে অপরাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন বাকৃবির শিক্ষার্থীরা। কিছু কিছু শিক্ষকও একই দাবি জানান।

শুধু ১৬ জন শিক্ষার্থীরই নয়, ১৬টি পরিবারের সেই স্বপ্ন বিধ্বস্ত করেছে ছাত্র রাজনীতি। মায়ের চোখের পানি হয়তো শুকিয়ে গেছে কিন্তু হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আজো অঝোরধারায় বইছে। শেষ সান্ত্বনা ছেলের হত্যাকারীদের সুষ্ঠু বিচার হয়তোবা পাবেন। সময়ের পরিক্রমায় সে আশায় গুড়ে বালি। অনেক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজো আলোর মুখ দেখেনি। তা হলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনিদের কোনো বিচার নেই? তারা কি আইনের ঊর্ধ্বে? এমন প্রশ্ন আজ সুধী সমাজের।

- বিজ্ঞাপন -

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতির জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ হয়েছে শতাধিকবার। আহত হন সহস্রাধিক এবং নিহত হন ১৬ জন। প্রথম খুনটি হয় ১৯৭৩ সালে। কর্মচারী-শিক্ষক-ছাত্র সংঘর্ষে প্রথম নিহত হন রঞ্জিত। এর পর থেকে শুরু হয় হত্যার রাজনীতি। টানা ১০ বছরের শান্ত ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয় ১৯৮৩ সালে। ওই বছরে ছাত্রদলের নেতা এ টি এম খালেদ নিহত হওয়ার জের ধরে প্রতিপক্ষের বুলেটে নিহত হন ছাত্রলীগ ও বাকসুর নেতা শওকত, ওয়ালী ও মহসিন। অতঃপর টেন্ডারবাজি, সিট দখল, বাজেট বণ্টন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১৯৯৩ সালে খুন হন রেজাউর রহমান সবুজ। ১৯৯৪ সালে কর্মচারীর কলেজ পড়ুয়া ছেলে, ১৯৯৫ সালে বাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আলাউদ্দিন, শওকত, কবির ও হাসান নামে চার শিবিরকর্মী এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হন কামাল ও রণজিৎ নামে দুই ছাত্রলীগ কর্মী। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ছাত্রদল চার গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়, যার ফলে ২০০১ সালে খুন হন ছাত্রদল নেতা হাসু।

২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ ভাগ বাটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাকৃবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত হয় পাশের গ্রামের ১০ বছরের ছোট শিশু রাব্বী। ছাত্রলীগের আন্তঃকোন্দল, গ্রুপিং, নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদকসহ বিভিন্ন কারণে সভাপতি ও সম্পাদক গ্রুপের সংঘর্ষের জেরেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের পিটুনিতে মারা গেছেন মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শেষ বর্ষের ক্লাস প্রতিনিধি ও আশরাফুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সায়াদ ইবনে মোমতাজ (সাদ)।

বাকৃবি ক্যাম্পাসে আজ পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতির জেরে ১৬টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও একটিরও বিচার পায়নি কোনো পরিবার। সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট হিমাগারে জমাটবদ্ধ, বিচার হয়নি কোনোটির। আর এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে ছাত্র রাজনীতির নামে অপরাজনীতির ভয়াল থাবা।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ছাত্র রাজনীতি সাধারণ ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নয়, দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। ফলে ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বর সহপাঠীদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির নামে চলমান অপরাজনীতির ফলেই এসব হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন নিষিদ্ধ নয়, দরকার সংস্কার। শিক্ষক রাজনীতির ফলে শিক্ষকেরাও সরকার দলীয় ছাত্র নেতার অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী শামসুন নাহার অয়ন্তী মত প্রকাশ করে বলেন, ছাত্র রাজনীতিতে ব্যক্তি স্বার্থ প্রাধান্য পায়। গত ক্ষমতাসীন দল সেটা বহুলাংশে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে। ঠিক এই কারণে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে। আমরা আশঙ্কা করি সামনের দিনগুলোতেও কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ছাত্র রাজনীতির ছায়াতলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর জুলুম করবে। আর শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য কোনো রাজনৈতিক ট্যাগের প্রয়োজনীয়তা নেই কোটা সংস্কার আন্দোলন তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। আমরা সবাই একটি বৈষম্যহীন ও সাম্যবাদী ভবিষ্যতের আশা রাখি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি ও হিস্টোলজি বিভাগের লেকচারার মোছা. লতিফা আক্তার বলেন, আমি নিজেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি চাই না। আমি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের  মাঝেও সবসময় সেটা প্রমোট করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে বাধ্য হয়ে অনেক শিক্ষার্থী রাজনীতি করতো। এই একই বিষয় আবার জুনিয়র শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও আছে, ইচ্ছে না থাকলেও শিক্ষকদের বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপে নাম লিখাতে হয়। কিন্তু সবকিছু দেখার পর আমার সবসময় এটাই মনে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী কোনো রাজনীতিই থাকা উচিত না। কারণ শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেক ছাত্রছাত্রীর ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায় এই রাজনীতির জন্য এবং শিক্ষকদের মান মর্যাদা নষ্ট হয়।

এসএস/

spot_img
spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ প্রকাশিত

spot_img