জাবি প্রতিনিধি:
প্রেমিকা ও বর্তমান স্ত্রীকে ক্লাসে বাড়তি সুবিধা দিতে ব্যাচের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে অন্যায় অবিচার করার অভিযোগ উঠেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
অভিযুক্ত শিক্ষক লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান সৈকত এবং তার স্ত্রী ৪৩ তম ব্যাচের ছাত্রী, সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত একই বিভাগের প্রভাষক ফাইরুয আনিকা।
জানা যায়, লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রভাষক থাকাকালীন মাহফুজুর রহমান সৈকত নিজ বিভাগেরই ছাত্রী ফাইরুয আনিকার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। সে সুবাদে ক্লাসে ও পরীক্ষায় ফাইরুয আনিকাকে বাড়তি সুবিধা দিতে মরিয়া ছিলেন মাহফুজুর রহমান। তাকে সুবিধা দিতে গিয়ে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের উপর নানাভাবে হুমকি ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছেন তিনি।
অভিযোগ উঠেছে স্নাতক শ্রেণীতে ফাইরুয আনিকাকে বিভাগে ১ম স্থান দিতে নানা অসৎ উপায় অবলম্বন করেছেন মাহফুজ সৈকত। আওয়ামীলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে থাকায় বিভাগে তার দাপটও ছিলো অনেক। সে সুবাধে ক্যাম্পাসের অন্যতম প্রভাবশালী লোকপ্রশাসন বিভাগের এক শিক্ষককে কাজে লাগিয়ে সম্প্রতি ফাইরুয আনিকাকে ঐ বিভাগে শিক্ষক হিসেবেও নিয়োগ পাইয়ে দিয়েছেন তিনি।
মাহফুজুর রহমান সৈকত বিভাগে প্রভাবশালী হওয়ায় ও ফলাফল বিপর্যয় হওয়ার ভয়ে তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা এতদিন কিছু না বললেও সাম্প্রতিক শিক্ষক বিতর্কে তার বিরুদ্ধে মুখ খোলতে শুরু করেছেন ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। এরই সাথে তার নানা অনিয়ম ও অশিক্ষকসুলভ কর্মকান্ড প্রকাশ করতে শুরু করেছে বিভাগের অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও।
সম্প্রতি ৪৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী ‘নিছক প্রেমের গল্প নয়’ শিরোনামে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপে মাহফুজ সৈকতের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি পোস্ট করেছেন।
সেখানে তিনি লিখেছেন, বাসার লজিং টিচারের সাথে ছাত্রীর প্রেমে ক্ষতি নেই৷ কিন্তু এক প্রেমে যদি একটা পুরো ব্যাচকে বিনষ্ট করে দেয়া হয়, তবে সেটা কারো ব্যক্তিগত নয়। কারো ব্যক্তিগত জীবনের সাথে যদি প্রফেশনাল লাইফের এতো মাখামাখি থাকে, তবে সেটা আর পার্সোনাল থাকে না। প্রিয় স্যার এবং প্রিয় গর্বিত ব্যাচমেট। (হ্যাপী কাপল)। প্রথমেই একটা কথা বলা জরুরি, এখানে ব্যক্তিগত আক্রোশ নেই। যা আছে সেটা চাপা ক্ষোভ বলতে পারেন।
ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী উল্লেখ করেছেন, বিভাগের উনার ঘনিষ্ঠ কিছু সহকর্মীদের মাধ্যমে ও একজন প্রভাবশালী শিক্ষকের সহায়তায় পরীক্ষা কমিটিতে অভিযুক্ত মাহফুজ প্রভাব খাটাতেন ফাইরুয আনিকাকে ১ম বানাতে। একবার বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে উপস্থিত না হওয়ায় ব্যাচের সবার উপস্থিতি মার্কস ২ নাম্বার করে কাটলেও পুরো নাম্বার দেন ফাইরুয আনিকাকে। ফাইনাল পরীক্ষার একটা কোর্সে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়ায় ফাইরুয আনিকার পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত শিক্ষককে অফিসে পাঠিয়ে মাহফুজ দায়িত্ব পালনের নামে বাইরে দাড়িয়ে থেকে আনিকাকে সহপাঠিদের সাথে মিলেমিশে লেখার সুযোগ করে দেয়। স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষার অভিযুক্ত শিক্ষক অনেক প্রচেষ্টা করেও শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে ব্যর্থ হন পরীক্ষা কমিটির সদস্য হতে। ফলে ফাইনাল বর্ষে ফাইরুয আনিকা প্রথম স্হান হতে পারেনি। সেটা অব্যাহত ছিলো স্নাতকোত্তরেও।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, স্যারের গার্লফ্রেন্ডের ইউ আর পি বিভাগের আরেকজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়। ছেলেটাকে স্যার এমন চাপ দেয়ায় ওই ডিপার্টমেন্ট থেকে, ছেলেটা জাবি তে মাস্টার্সই করেনি। একদিন ঘুরতে যাওয়ার জন্য এক ছাত্র’কে এমন যন্ত্রণা না দিলেও হতো।
শিক্ষক নিয়োগের বোর্ডের আগে যখন বিভিন্ন নিউজ
ছড়ায় তখন পিও বান্ধবী আমাদের ব্যাচের একজনকে ফোন দিয়ে বলে, তোরা এই বোর্ডের আগে কিছু বলিস না, ভাইভা ফেলের কষ্ট তো তোরা জানিস! আর উনি প্রাইভেট এর টিচার ছিলেন? সেটাও পার্ট টাইম। এই অভিজ্ঞতা দিয়ে চাকরি হয় না। তার চাকরি হয়েছে (অনেকে বলে আনথরাইজড পৌষ্য কোটায়) পিও স্যারের বউ হিসেবে।
এছাড়াও তার ব্যাচমেট আরেক শিক্ষার্থী ‘একটি ফোন কলের গল্প বলি’ শিরোনামে এবং আরো অনেকেই অভিযুক্ত শিক্ষক মাহফুজ সৈকতের অন্যায় অনাচার সম্পর্কে পোস্ট করেছেন।
এসব পোস্টে উক্ত ব্যাচের বহু শিক্ষার্থী তার অপকর্ম নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন।
এছাড়াও বিভাগের বিভিন্ন ব্যাচের অগণিত শিক্ষার্থী তার নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করেছেন। নিয়মিত ক্লাস না নেয়া, গাজা সেবন করে রক্তিম চোখে দেরীতে ক্লাসে আসা, ফাইনাল পরীক্ষার সময় আসলে টিউটোরিয়াল মার্কস দেয়া, ক্ষমতার দাপট দেখানো, বিভাগের বহু উগ্র আচরণ করা, পরীক্ষা কমিটিতে ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন না করা, থিসিস সুপারভাইজার হিসেবে শিক্ষার্থীদের অবহেলা করা, ব্যক্তিগত জীবনে বেপরোয়া মনোভাব দেখানো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশিক্ষকসূলভ কার্যক্রম প্রদশর্ন সহ শতশত অভিযোগ উত্থাপন করেন বিভাগের ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
তার এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন ও অবৈধ উপায়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষক ফাইরুয আনিকার নিয়োগ বাতিলের আহব্বান জানিয়েছেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
এর আগে, বিভাগের সদ্য সাবেক সভাপতি নুরুল আমিনের অধীনে নিয়োগ পাওয়া তিন প্রভাষকের নিয়োগ বাতিল চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে চেয়ারম্যান বরাবর পৃথক দুটি আবেদন করা হয়। এর একটির ‘রিসিভ কপি’ এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
গত বছরের জুলাই ২৪ জমাকৃত ঐ আবেদনে ফাইরুয আনিকার বিষয়ে লেখা হয়, ফাইরুজ আনিকা: লোক-প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুর রহমানের সাবেক প্রেমিকা ও বর্তমান স্ত্রী। আনিকা বিভাগে ভর্তির পর থেকেই মাহফুজুর রহমানের সাথে প্রেম করে আসছে এবং তার রেজাল্ট কারচুপি করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে । মাহফুজুর রহমান আনিকাদের ব্যাচে দ্বিতীয় বর্ষে Public Policy ও তৃতীয় বর্ষে Ethics in Public Administration পড়িয়েছেন এবং পক্ষপাতমূলক মার্কিংয়ের অভিযোগ আছে। এছাড়া মাহফুজুর রহমান এই ব্যাচের একটি পরীক্ষা কমটির সদস্যও ছিলেন। এবং মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের ব্যাপারে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিলো।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মাহফুজুর রহমান সৈকত বলেন, ফাইরুয আনিকা যখন ১ম বর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছে তখন আমি জুনিয়র শিক্ষক ছিলাম। আমার তো সেই ক্ষমতা ছিলোনা। তাদের ব্যাচে আমার কোর্স থাকলেও আমি তাদের সময় কোন পরীক্ষা কমিটিতে ছিলামনা। শিক্ষক নিয়োগের সময়ও আমার অত ক্ষমতা ছিলোনা। সে নিজ যোগ্যতায় শিক্ষক হয়েছে।
ক্লাসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ক্লাস একটু কম করিয়েছি। ২৫ থেকে ৩০টা ক্লাস নিয়েছি।
এ বিষয়ে প্রভাষক ফাইরুয আনিকা বলেন, আমি নিজের মেধা ও যোগ্যতায় এ অবস্থানে এসেছি। শিক্ষকের স্ত্রী বলে অনেকে আমার সাথে ষড়যন্ত্র করতেছে। কয়েকজন ছেলেমেয়ে আমার বিরুদ্ধে এসব বলেছে। আমি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করবো। আমি আইনজীবীর সাথে আলাপ করতেছি।
ঐ বিভাগের সভাপতি হরে কৃষ্ণ কুন্ডু বলেন, আমি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য দেশের বাইরে থাকায় ঐ ব্যাচের ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। তবে বর্তমানে উক্ত শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনিয়ম করে তাহলে প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহন করবো
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, আমরা এখনো সরাসরি অভিযোগ পাইনি। যদি এরকম কিছু হয়ে থাকে সেটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্হা নেয়া হবে। বিষয়টি প্রোভিসি (প্রশাসন) সমাধান করবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক শেখ মো মনজুরুল হক একাধিক বার কল দিয়েও পাওয়া যায় নি।
ইএইচ/
মন্তব্য করুন