spot_img

রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলি, ঠিক কী ঘটেছিল?

এসম্পর্কিত আরো পড়ুন

সারা দেশে কোটা আন্দোলনে এখন পর্যন্ত ২ শতাধিক ছাত্র ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মাঝে সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি)। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) সারা দেশে যে ছয়জন নিহত হয়েছেন, তাদেরই অন্যতম হচ্ছেন বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাঈদ।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।

- বিজ্ঞাপন -

নিহত অন্য পাঁচজনকে ছাপিয়ে সাঈদকে নিয়ে বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে, যার মূলে রয়েছে ঘটনার সময় ধারণ করা কিছু ভিডিও।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওইসব ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, পুলিশের তাক করা অস্ত্রের বিপরীতে সাঈদ বুক পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

এক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান ছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে। আর সাঈদ দাঁড়িয়ে ছিলেন ফটক থেকে সামান্য দূরে রাস্তার মাঝখানে। এমন সময় পুলিশের সদস্যরা হঠাৎ রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করেন। তখন সাঈদের হাতে একটি লাঠি ছিল, যা দিয়ে তিনি গুলি ঠেকানোর চেষ্টা করেন।

এ ঘটনার পর বেশ কয়েক পা পিছিয়ে তিনি সড়কের বিভাজক পার হন এবং হঠাৎ মাটিতে বসে পড়েন। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে সাঈদের মৃত্যু হয় এবং তার শরীরে রাবার বুলেটের একাধিক ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোর একটি বিশ্লেষণ করে বিবিসি বাংলার সেটি আসল বলেই নিশ্চিত করেছে। ভিডিওতে সাঈদকে সহিংস বা আক্রমণাত্মক কোনো রূপে চোখে পড়েনি।

কিন্তু তারপরও পুলিশ কেন তাকে লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছুড়ল? বিকল্প কোনো উপায়ে কি তাকে সরানো বা নিবৃত্ত করা সম্ভব ছিল?

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে পুলিশের অবস্থান|| ছবি: বিবিসি বাংলা

ঘটনা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

কোটা সংস্কারের দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে গত কিছুদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছে রংপুরের একাধিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের উপর হামলার ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার বেলা তিনটায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সমবেত হওয়ার ঘোষণা দেন তারা।

সেদিন সকাল থেকেই আন্দোলনের গতিবিধির দিকে নজর রাখছিলেন রংপুরের স্থানীয় সাংবাদিক শাহরিয়ার মিম। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বেলা তিনটার দিকে আন্দোলনকারীরা একযোগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে গেলেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয় বলে জানান তিনি।

বিবিসি বাংলাকে সাংবাদিক মিম বলেন, ‘পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করলে আন্দোলনকারীরা ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশ এরপর টিয়ারশেল এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।’

পুলিশের কঠোর অবস্থানের মুখে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই পিছু হটেন এবং আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।

“কিন্তু কিছু শিক্ষার্থী তখনও বিশ্ববিদ্যালয় ফটকের আশপাশেই ছিল। তাদের মধ্যে আবু সাঈদ পুলিশের সামনে গিয়ে বুক পেতে দাঁড়ান,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মিম।

পুলিশ শুরুতে আবু সাঈদকে অন্যত্র চলে যেতে অনুরোধ করে। কিন্তু সাঈদ বিষয়টি আমলে না নেওয়ায় পরবর্তীতে তাকে লক্ষ্য করে রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয়।

“আহত হয়ে মাটিতে বসে পড়ার পর আন্দোলনকারীদের কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয় এবং সেখানেই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়,” বিবিসি বাংলাকে জানান মিম।

নিহত আবু সাঈদের শরীরে একাধিক রাবার বুলেটের ক্ষত ছিল বলে বিবিসি বাংলাকে জানান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ ইউনুস আলী।

নিজ বিভাগের সামনে আবু সাঈদ

মোর হাসিনা মোর ছেলোক মারি ফালালি

নিহত আবু সাঈদের গ্রামের বাড়ি রংপুরে পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে। তার বৃদ্ধ বাবা মকবুল হোসেন পেশায় একজন দিনমজুর, যারা ছেলে-মেয়ের সংখ্যা নয় জন। অভাবের সংসারে এতগুলো ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র সাঈদই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। সম্প্রতি তিনি স্নাতক পরীক্ষা শেষ করেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন তার বোন সুমি বেগম।

“হামরা কেউ এতদূর লেকাপড়া কইরবার পারিনে। হামার ভাইডে নিজে কষ্ট করে, টিউশনি করে পড়ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন নিহতের বোন সুমি বেগম।

মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক, উভয় পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়ার পর সাঈদ ২০১৯ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন।

“হামার মাও-বাপের কত আশা, হামার ছেলি একটা চাকরি করবি। ভাইডে হামার মরি গেল। হামার মাওডে এখন কেঙ্গিরি বাঁচে,” আহাজারি করতে করতে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিজ বেগম।

ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর ঘটনায় আক্ষেপ করে তিনি বলছিলেন, “তার হাতেত কোনো অস্ত্র আছিল না। তার পাও দুডো ভাঙি দিলো না, হাত একটা ভাঙি দিল না। আমরা চিকিৎসা করি কথা বলি দুডো শান্তি পানু। ভায়োক হামার এভাবে মারাডা ঠিক হয় নাই। এর বিচার চাই।”

অন্যদিকে, সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম। আক্ষেপের সুরে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মোর হাসিনা মোর ছেলোক মারি ফালালি।”

সন্তান হারানোর খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত আবু সাঈদের স্বজনরা

মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে পুলিশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে জানাচ্ছেন অধিকার কর্মীরা।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দাবি আদায়ে নিজের মত প্রকাশ করা, আন্দোলন করা – এগুলো নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার, যার স্বীকৃতি আমাদের সংবিধানেও রয়েছে। সেখানে আন্দোলনকারী নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ কীভাবে গুলি চালায়! এই আক্রমণ বরদাস্ত করা যায় না। এটি করে পুলিশ মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে।”

তার মতে, গুলি না চালিয়েও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করার সুযোগ পুলিশের ছিল। তিনি বলেন, ‘ছেলেটার কাছে যেহেতু প্রাণঘাতী কোনও অস্ত্র ছিল না, কাজেই পুলিশের সহিংস হওয়ার কোনো দরকার ছিল না।’

এক্ষেত্রে প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নিয়েও তাকে ঘটনাস্থল থেকে সরানো যেত বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু পুলিশ সেটি না করে গুলি ছুড়লো। নিরীহ মানুষের উপর এমন আক্রমণ মোটেও মেনে নেওয়া যায় না বলেও উল্লেখ করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফয়সাল।

পুলিশ কী বলছে?

বাংলাদেশে পুলিশের কার্যক্রম মূলতঃ পরিচালিত হয় ‘পুলিশ আইন, ১৮৬১’, ‘ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮’ এবং ‘পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল, ১৯৪৩’ নামের তিনটি আইনের মাধ্যমে।

এই আইনগুলো সবক’টিই ব্রিটিশ শাসনামালে তৈরি। এসব আইনে বিশেষ কিছু অবস্থায় পুলিশকে শক্তি প্রয়োগ, এমনকী গুলি করারও এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সেটি কখন?

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহম্মদ নূরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এবং আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর এখতিয়ার পুলিশকে আইন দিয়েছে। তবে সেটি প্রপরশনেট লেভেল বা যৌক্তিক মাত্রায় হতে হবে।’

মঙ্গলবার দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সে ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোন পরিস্থিতিতে গুলি চালানো হয়েছে এবং এক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখার জন্য ইতোমধ্যেই আমরা চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি এবং একটি মামলাও করা হয়েছে।’

আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত শেষ ওই কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

“তদন্তে পুলিশের অভিযুক্ত সদস্যদের কারো দোষ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় শাস্তির পাশাপাশি প্রচলিত আইনেও বিচার করা হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান।

(মূল প্রতিবেদন বিবিসি বাংলার)

এসআই/

spot_img
spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ প্রকাশিত

spot_img