তানভীর খান: বর্তমানে দেশে সবথেকে আলোচিত বিষয় কালেমাখচিত কালো পতাকা। বেশ কয়েকদিন যাবত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা এই পতাকা নিয়ে মিছিল করেছে। এতে দেশব্যাপী বয়ে যাচ্ছে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। বিশেষ করে গতকাল (৪ অক্টোবর) ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মিছিল থেকে কালেমাখচিত কালো পতাকাবাহী তিনজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করার পর পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা এখন তুঙ্গে। এমতাবস্থায় আমাদের অবস্থান কী হতে পারে, কালো পতাকার পক্ষে না বিপক্ষে?
ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস সংবলিত কয়েকটি আরবি পঙক্তিকে কালেমা বলে। এখন বলতেই পারেন আমার বাকস্বাধীনতা রয়েছে আমার ধর্মের বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করার। তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে যখন পতাকাটি হয় আইএস-সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের পতাকার আদলে। এই পতাকা যখন বহির্বিশ্বে আপনার দেশকে উগ্রবাদী দেশ হিসেবে উপস্থাপন করবে তখন এই বিষয়টাও আপনাকে ভাবতে হবে। কালেমাখচিত পতাকায় কোনো সমস্যা না। সমস্যা ওই স্পেসিফিক ফন্ট আর কালারে। আপনার আমার কাছে এটা কেবল কালিমা লেখা পতাকা হলেও বিশ্বজুড়ে এটা আইএসের প্রতীক হিসেবেই পরিচিত। অতএব আপনি এখানে যে উদ্দেশ্যেই সেই কালো পতাকা উড়ান, এই ছবি পার্শ্ববর্তী দেশের মিডিয়াসন্ত্রাস বিশ্ব দরবারে জঙ্গীবাদের উত্থান হিসেবেই ফুটিয়ে তুলবে।
ধর্ম মানুষের আবেগের এবং আত্মবিশ্বাসের জায়গা। আর যুগে যুগে বারবার মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে এই জায়গাটিকে ব্যবহার করেই। এটা করা হয় সুপরিকল্পিতভাবেই। ইতিহাসে এর বহু নজির রয়েছে। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মকে অতিরঞ্জিত জিহাদী গল্প শুনিয়ে বিপথগামী করার পেছনে তথাকথিত শায়েখদের রক্ত গরম করা বক্তব্য অনেকাংশে দায়ী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এদের জিহাদী বক্তব্য শুনে তরুণরা বিপথগামীতার পথে পা বাড়াচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীর হাতে কালেমাখচিত পতাকা যে ব্যক্তি দিয়েছিল তাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে গেলে পতাকা গুছিয়ে নিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে। তাই কালেমাখচিত পতাকা দেখেই আবেগ তাড়িত হওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে সদ্য স্বৈরাচার থেকে মুক্তি পাওয়া নানাবিধ সমস্যা ও ষড়যন্ত্রের মুখে অবস্থান করা একটি দেশে। বরং এই পতাকা কারা, কখন, কোন পরিস্থিতিতে এবং কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে কারা ধরিয়ে দিচ্ছে সেটাও খুঁজে দেখা দরকার।
শেখ হাসিনার শোষণে দীর্ঘদিন পিষ্টাবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া দেশের এই পরিবেশে এখন কোন বিষয় বা ইস্যুটা এক নম্বর অগ্রাধিকার লিস্টে থাকা উচিত, সেটা নির্ণয় করা দেশের মানুষের জন্য খুবই জরুরি। কারণ কোনো ভুল পদক্ষেপ স্বাধীনতার স্পিডকে নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। দেশ স্বাধীন না থাকলে সাদা, কালো, লাল কোনো পতাকাই উড়াতে পারবেন না।
এই অবস্থায় দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বিশালসংখ্যক জনসমর্থন রয়েছে, তাদের উচিত হবে বহির্বিশ্বে দেশ সম্পর্কে ভুল বার্তা ছড়ায় এমন কাজ থেকে জনগণকে বিরত থাকতে আহ্বান করা। এই মুহুর্তে প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, প্রোপাগাণ্ডা ও ষড়যন্ত্র ধরতে না পারা এবং শত্রু-মিত্র, ভুল-সঠিক ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে সবথেকে বেশি বিপদে পড়বে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোই।
সারা পৃথিবী কালো রঙের কালেমাখচিত পতাকা আইএস এর সূচক হিসেবে গন্য করে, এই ব্যাপারটাকে ইস্যু করে দেশকে ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করতে পারে সদ্য বিতাড়িত ফ্যাসিবাদ ও ভিনদেশি মিডিয়াসহ তাদের নানাবিধ ষড়যন্ত্র। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত এসব অযাচিত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা উচিত। মনে রাখা উচিত সহস্র শহীদের রক্ত ও হাজার হাজার আহত পঙ্গুত্ববরণকারী ছাত্র জনতার ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে আমাদের অপরিণামদর্শী কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মের কারণে নষ্ট করে দিতে পারি না।
লেখক: তানভীর খান
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।