সজীব চৌধুরী:
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী দ্রব্যের ব্যবহার চরমসীমা অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের পরিবেশও মাত্রাতিরিক্ত প্লাস্টিক ব্যবহারের কারণে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক এবং পুনর্ব্যবহার না করা প্লাস্টিক সামগ্রী আমাদের মাটি, পানি, এবং বায়ুকে দূষিত করছে। প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রকণাগুলি খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স ২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বে ১৭৫তম অবস্থানে রয়েছে (স্কোর: ২৮.১০), যেখানে পরিবেশ- সম্পর্কিত ৫৮টি বিষয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, বৈশ্বিক প্লাস্টিক দূষণের ২.৪৭ শতাংশ ঘটে বাংলাদেশে।
এ সমস্যা সমাধানে দেশের নীতিনির্ধারক, স্টেকহোল্ডার তথা সরকার বিগত দুই দশক ধরেই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে এ আইনের প্রয়োগে অভিযান চালানো হয়, যার মাধ্যমে কিছু পরিমাণ পলিথিন জব্দ করা হয়, তবে তা পুনরায় হাসতে হাসতে বাজারে প্রবেশ করে।
জুলাই বিপ্লবের পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ বন ও জলবায়ু এবং পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দ রিজওয়ানা হাসানের উদ্যোগে পুনরায় বিষয়টি সামনে এসেছে। তার নির্দেশমতে, ১লা অক্টোবর থেকে সুপারশপে এবং ১লা নভেম্বর থেকে কার্ডীবাজারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই উদ্যোগকে পুনরায় সামনে আনার জন্য তাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে। কারন, এটির ব্যবহার সীমিত করা না গেলে দেশের পরিনতি হবে ভয়াবহ। পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ হলো আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, ২০০২ সালে করা আইন দুই দশক পার হবার পরেও কেনো আলোর মুখ দেখে নি। আসলেই কি আইন আর আইনের প্রয়োগে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব?
আমার মাস্টার্সের থিসিস এর বিষয়বস্তু ছিলো এন্টি-লিটারিং (Anti-littering) এর সাথে পরিবেশগত স্বাক্ষরতার সর্ম্পক নিরূপন নিয়ে। যেটি করতে গিয়ে এ বিষয়ের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাসহ মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি শুধুমাত্র আইন বলবৎ করে এ সমস্যার স্বল্পমেয়াদী সমাধান সম্ভব হলেও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব হবেনা। এ বিষয়ে কিছু তাত্ত্বিক এবং সাধারন অর্থনৈতিক বিষয়ের অবতারণা করা জরুরী।
বিকল্প দ্রব্য, খরচ, চাহিদা ও যোগান-এ চারটি বিষয়ের সাথে পলিথিন নিষিদ্ধকরণ কার্যকরী হবে কিনা এটি জড়িত। বর্তমানে, পলিথিনের প্রচুর বিকল্প বাজারে আছে যেমন, পাটজাত ব্যাগ, ব্রাউন ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ ইত্যাদি। কিন্তু খরচের সাথে তুলনা করলে এর কোনোটিই পলিথিনের পুরোপুরি বিকল্প হতে পারে নি। ঠিক এই কারনেই, বাজারে এই সব বিকল্পের আনাগোনা থাকলেও তা পলিথিনের সাথে দৌড়ে হেরে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পলিথিনের ব্যাপক বাজার চাহিদার সাথে রয়ে গেছে একটা মজবুত সাল্লাই চেইন ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম। সময়ে সময়ে কিছু অভিযানের মাধ্যমে পলিথিন জব্দ করা হলেও তা এই মজবুত সাপ্লাই চেইনকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট নয়। পরিপূর্ণ বিকল্প দ্রব্যের অভাব এবং ব্যাপক বাজার চাহিদা থাকার কারনেই শুধু আইনের প্রয়োগ করে স্বল্পমেয়াদে যোগান সীমিত করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া সম্ভব হবে না।
বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এ ধরনের পরিবেশ-বিরোধী আচরনের (anti- environmental Behavior) দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের অনেক দিকনির্দেশনা রয়েছে। তারই মধ্যে প্রণোদনা তত্ত্ব (Nudging Theory) একটি যা আচরণগত অর্থনীতিতে আলোচনা করা হয়ে থাকে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী কঠোর নিয়ম বা বাধ্যবাধকতা না করে মানুষের সিদ্ধান্ত ও আচরণে প্রভাব ফেলে এমন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়েছে- যা একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। আরো দুটি বিষয়ের আলোচনা জরুরী, ব্যক্তিবাদ এবং সামষ্টিবাদ (Individualism and Collectivism) দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ধারণা, যেগুলো মানুষের জীবনধারা, মূল্যবোধ এবং সামাজিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। এদের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো ব্যক্তি এবং সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যক্তিবাদে ব্যক্তি তার নিজস্ব স্বাধীনতা এবং লাভের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়। এখানে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্বার্থ অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং তাদের কর্মের ফলাফলও তাদেরই কর্তৃত্বাধীন থাকে।
পরিবেশগত অর্থনীতিতে ব্যক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হলে, ব্যক্তিরা স্ব-স্ব লাভের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে, যা প্রায়ই পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে। অপরদিকে, সামষ্টিবাদে জনগণের কল্যাণ এবং সমাজের বৃহত্তর স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে পরিবেশগত অর্থনীতি একসাথে কাজ করার, সম্পদ এবং উন্নয়ন সবার মধ্যে ভাগ করার ধারণাকে তুলে ধরে।
সমাজের বেশিরভাগ মানুষই ব্যাক্তিবাদে বিশ্বাসী। সামষ্টিবাদকে সরকাররের বিষয় বলতেই অভ্যন্ত আমরা। এজন্যই পরিবেশ সম্পর্কিত সকল কিছুকেই আমরা সরকারের দায়িত্বে ছেড়ে বসে থাকি আর সরকারও শুধু আইন পাস করে তার দায়িত্বের অবসান ঘটিয়ে থাকে। এভাবেই এই সমস্যাগুলি অবহেলিত থেকে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পথে বাঁধা হয়ে দাড়াই। এজন্যই মানুষের ভেতর সামষ্টিক ধারনার অবতারণা করা জরুরী। এটি যে দীর্ঘকালে আমারই ক্ষতির কারন-এ ধারনাটির বিস্তার ঘটাতে না পারলে কোনো আইনেই এটির সমাধান করা সম্ভব হবে না।
এক গবেষণালব্ধ ফলাফল থাকতেও পলিসিমেকারেরা সহজলব্ধ সমাধান খুজে নিতে পছন্দ করে যা স্বল্পকালে বাহবা কুড়ালেও দীর্ঘকালে কোনো প্রভার রাখতে পারে না। আইন প্রণয়ন একটি সহজলভ্য সমাধান হলেও পলিথিনের বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদে সমাধান আনতে ব্যর্থ হবে কারন এটি শুধু যোগানকে সীমিত করার একটি উপায়। মানুষের চাহিদাকে সীমিত করতে হলে অবশ্যই আচরণগত বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তনের প্রচেষ্টা করতে হবে।
প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার পাশাপাশি এই ধরনের পরিবেশ বান্ধব কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত করা বাধ্যতামুলক করতে হবে। প্রায় প্রতিটি মহল্লায় একটি। দুটি প্রাইমারী স্কুল থাকে। সেই এলাকায় পলিথিনের ব্যবহার সীমিত করা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে প্রতিটি ওয়ার্ডে বছরে কয়েকবার ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। এতে সেই শিক্ষার্থীদের আচরণ যেমন পরিবর্তন হবে তেমনই তাদের দ্বারা তাদের পরিবার প্রতিবেশিরাও প্রভাবিত হবে। এই প্রক্রিয়াতে আজকের শিশু আগামী দিনের পরিবেশবান্ধব সম্পদে পরিণত হবে। পাশাপাশি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামষ্টিবাদ সম্পর্কিত ভিডিও, কার্টুন অন্যান্য বিষয়গুলোর ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবেশ সংশ্লিষ্ট গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে এবং পলিসিমেকারদের ডিসিশন গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে নিতে হবে। মানুষের আচরণগত এই পরিবর্তনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া এখনই শুধু করা না গেলে তা আমাদের জন্য কোনো সুখকর ভবিষ্যত তৈরি করতে পারবে না।
লেখক:সজীব চৌধুরী, গবেষণা কর্মকর্তা (অর্থনীতি)
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা।