ইনামুল হক:
শোষণের থাবা থেকে মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস বহু পুরানো। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার সংগ্রাম থেকে শুরু করে মঙ্গল পান্ডের সিপাহি বিদ্রোহ বা ৪৭’র দেশভাগের আন্দোলন যা বাঙালি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ভৌগোলিক মুক্তির আন্দোলন। সর্বশেষ বাঙালির নব্য উপনিবেশবাদ আন্দোলনের ফল ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক মুক্তির এবং জাতিগত বাঙালী ও ভৌগোলিক বাংলাদেশী পরিচয়ে পরিচিতি হয়ে উঠার চূড়ান্ত ফলাফল হলো ৭১ এর বিজয়।।কিন্তু এই বিজয় কি আমাদের নবজাগরণের বিজয় দিয়েছে?
১৮২৬ এর দশকে শুরু হওয়া ডি রোজিও এর “ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী” কিংবা বিংশ শতাব্দীর ” বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন” যে জাগরণ ঘটিয়ে আমাদের মুক্তি দিতে চেয়েছে, আজো স্বাধীন বাংলাদেশে সেই মুক্তি প্রকৃতপক্ষে কতটুকু পেলাম। আজো আমরা পড়ে আছি সেই মধ্যযুগীয় চিন্তা ধারার ঘুর্নায়মান ধাঁধার ভিতরে। যুগে যুগে সভ্যতার বিনির্মান হয়েছে নতুন চিন্তা বিকশিত হওয়ার ফলে, ধারণা বদল করার ফলে। কিন্তু বাংলাদেশীদের সেই চিন্তার জগতে কতটুকু পরিবর্তন হলো? ৯০ থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২৪ এর ফ্যাসিবাদের বিদায়। তবে কি এখানেই শেষ? বারবার রাজনৈতিক বিপ্লব হলেও সংস্কৃতির বিপ্লব কিংবা চিন্তাধারার বিপ্লব কই?
বাঙালি এখনো আরেক বাঙালির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারেনি। বাঙালির বিনয়ের থেকে ঔদ্ধত্য বেশি,।বাঙালির জ্ঞান চর্চার থেকে পরচর্চায় সিদ্ধহস্ত।বাঙালির সহানুভূতির থেকে ইগোফোবিয়ায় ভোগে বেশি।বাঙালির ধৈর্যের থেকে চাঞ্চল্যতা বেশি কাজ করে। বাঙালি সংক্ষিপ্ত উপায়ে কঠোর সাধনার পথ খুঁজে বেড়ায়।
বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে উপনিবেশবাদের ধারণা। তৃতীয় শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ৩০০ তে ৩০০ পেলেই ভেবে থাকি সে জীবনে উন্নতি করবে। যে শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশুনা করে, আমরা ধরে নিই সে মেধাবী এবং তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আমরা কখনই শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকাশে সহযোগীতা করি না,বরং তাকে গোয়ালে রেখে পোষা গরুর মত সীমাবদ্ধ দুনিয়ার ভিতরে রেখে চাপিয়ে দিই নিজ মতামত। যার ফল হিসেবে আমরা পাই প্রতি বছর এসএসসি, এইচএসসি কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার পরে কিছু আত্মহত্যার চিত্র এবং বর্তমান সময়ে সেসব শিক্ষার্থীদের সুইসাইড নোটে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দেখি পরিবার এবং সমাজের রুক্ষ কটাক্ষ থেকে নিজেকে পরিত্রাণ দেওয়া।
কেউ আত্মউন্নয়ন বা সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ করলে আমরা তার পাশে থেকে অনুপ্রেরণা না দিয়ে বরং তাকে নিয়ে মেতে উঠি তাকে হেয় করার সমালোচনায়।তাকে নানা উপায়ে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য উঠে পড়ে লাগি। আমরা ভেবে থাকি আমি নিজেই সঠিক, অন্যের সিদ্ধান্ত ঠিক না। কখনই অন্যের পরামর্শ বা সিদ্ধান্তের উপর সহনশীল হতে পারি না। নিজের সীমাবদ্ধ জ্ঞানটাই যেন শ্রেষ্ঠ জ্ঞান এবং নিজের জানাটাই যেন সেরা জানা ধরে নিয়ে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার চেষ্টা করি। আমাদের সব থেকে বড় বিষ্ময় হলো আমরা নিজেদের কোনো কাজ বা তথ্যে ভুল জানার পরেও সেটা স্বীকার না করে বরং সেই ভুলটাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই লড়াই চালিয়ে যাই।
আমাদের ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন সব জায়গায় দেখি শুধু অন্যকে হেয় করার,শোাষণ করে রাখার প্রতিযোগিতা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমরা অন্যকে ছাপিয়ে যেতে চাই তাকে ক্ষতির সম্মুখীন করে। প্রতিনিয়ত আমাদের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠছে অন্যের কটাক্ষ আর সমালোচনায়। সমালোচনা মানুষের আয়না স্বরূপ। একজন ব্যক্তির ভালো পদক্ষেপ নেওয়া বা খারাপ পদক্ষেপগুলো শুধরে নিতে সাহায্য করে তার করা কাজগুলোর প্রতি অন্যের করা সমালোচনা দিয়ে। কারণ সমালোচনার মাধ্যমে নিজেকে যাচাই করা যায়, তার পদক্ষেপগুলো কি ধরণের হতে চলেছে সে ব্যাপারে সে নিজেই একটা ধারণা নিতে পারে সমালোচনার মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের বর্তমান সমালোচনাগুলো হয় ব্যক্তি,বন্ধু,পরিবার বা সমাজকে কটাক্ষ করার জন্য তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। আমরা শুধরানোর জন্য সমালোচনা করতে পারি না।
সুস্থ চিন্তাধারা বিকশিত করতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বাঁকা দিকে না নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিচার করতে হবে।অন্যের কাজের সমালোচনার আগে নিজেকে তার জায়গায় কল্পনা করে তাকে পরামর্শ বা সমালোচনা করাই উত্তম। আমাদের প্রতিনিয়ত চলার পথে ধন্যবাদ,দুঃখিত,ভুল হয়েছে ইত্যাদি বিনয়ের কথাগুলো ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে।অন্যের চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।
নিজেকে আরো আত্মউন্নতির পথে নিয়ে যেতে হবে।নিজেকে সময় দিতে হবে,পরিবারকে সময় দিতে হবে যাতে সন্তানেরা সঠিক কর্মপরিকল্পনার ভিতর দিয়ে বিকশিত হতে পারে।তাত্ত্বিক চিন্তা করতে হবে এবং তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে।তাহলেই সমাজের পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করবে।বলাবাহুল্য, আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ করতে ভালোবাসি। তাদের বাহ্যিক দিক অর্থাৎ পোশাক-পরিচ্ছদে তাদের অনুকরণ করতে বর্তমান সময়ে বেশ তৎপর কিন্তু তাদের ভেতর গত অর্থাৎ আচার-আচরণ, শিক্ষা-দীক্ষা ও মননে তাদের অনুকরণ করতে পারিনি এখনো।আমাদের উচিত তাদের বাহ্যিক দিকগুলো অনুকরণের থেকে তাদের মনোগত দিকের অনুকরণ চর্চা করা।একই সাথে ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রেখে অন্যের প্রতি আচারণ সম্পর্কে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো যে দিক নির্দেশনা দেয় তা অনুসরণ করা এবং কৈশর জীবনে বাচ্চাদের চর্চা করানো থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনুশীলন করা জরুরি।
ইনামুল হক, শিক্ষার্থী
বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন