spot_img

দেশের উন্নয়নে বৈষম্যমুক্ত বায়োটেকনোলজি সেক্টর চাই: ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন

এসম্পর্কিত আরো পড়ুন

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। ছাত্র-জনতার এই বিজয় সকল ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করেছে। দেশের উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে, বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন কী ধরনের প্রভাব ফেলছে এবং নতুন বাংলাদেশে এই সেক্টরের প্রত্যাশা কী, সে সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ সাইন্স স্কুলের ডিন এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। গুরুত্বপূর্ণ এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একরামুল হক

প্রশ্ন: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রজনতার বিজয় আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

- বিজ্ঞাপন -

ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন: জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ এবং তাদের অর্জিত বিজয়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে একটি স্বৈরশাসককে জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিই পরাজিত করতে পারে। এই আন্দোলনে মানুষ মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াই করেছিল এবং সেই লক্ষ্যে সফল হয়েছে। ছাত্ররা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং তাদের আত্মত্যাগ ও দৃঢ়তায় এই আন্দোলন সফল হয়েছে। আন্দোলনের পর ছাত্ররা সমাজে পরিবর্তনেও অবদান রাখছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশে মানুষের অনেক আকাঙ্ক্ষা। দেশের বর্তমান নেতৃত্বকে যদি সময় দেওয়া হয় তাহলে তারা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে মানুষের আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ করতে পারবে এটাই আমাদের বিশ্বাস।

প্রশ্ন: দেশের উচ্চশিক্ষার ওপর এই আন্দোলনের কেমন প্রভাব পড়তে পারে?

ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন: আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল আমরা এখনো সেখান থেকে বের হতে পারিনি। আমাদের এখান থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হল, আমরা আগে মনে করতাম শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই দেশের প্রয়োজনে আন্দোলন সংগ্রাম করে বা ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু এই আন্দোলনে আমরা দেখেছি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাও সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তাদের অবদানকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শুরু থেকেই তারা বৈষম্যের মধ্যে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের ডিগ্রি অর্জন করার পরেও বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ দেওয়া হত না। সবমিলিয়ে এই আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রাখলে আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের শিক্ষা যেন ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে ক্যারিয়ার পর্যন্ত কাজে লাগে সেভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। এই আন্দোলনের পর দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন হচ্ছে আশা করছি বর্তমান শিক্ষা ক্ষেত্রেও এই সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবে।

তবে আমরা দেখছি অনেক ক্ষেত্রেই সরকার পরিবর্তনের পর নতুন যে প্রশাসন এসেছে তারা পুরাতন প্রশাসনের পথ ধরেই হাঁটছে। জুলাই আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা সেটি ছিল না। আমি মনে করি জুলাই আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে সামনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আগের নিয়ম অনুসারেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, রেজিস্ট্রারসহ প্রশাসনিক সকল পদে নিয়োগ হচ্ছে। আগে নিয়োগ হতো আওয়ামীদের, এখন হচ্ছে তার উল্টো। এই বিষয়গুলো পরিবর্তন হওয়া জরুরী। জুলাইয়ের আন্দোলন যে শেষ হয়ে গেছে তা নয়। যেখানেই সমস্যা, সেখানেই এই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলন শেষ হওয়ার তিন মাস হয়েছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমূল পরিবর্তন হয়নি। তবে আমি আশা করি পরিবর্তন হবে। অবশ্যই সবকিছুর সুন্দর পরিবর্তন হতেই হবে।

প্রশ্ন: দেশে বায়োটেকনোলজি ফিল্ডের কেমন সম্ভাবনা এবং কী কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন?

ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উন্নতদেশগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান ব্যবহার করে তাদের সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে তার সম্পদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। তবে এখনো আমরা সেই উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারিনি। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ সরকার মনে করেছিল এই উন্নয়নের একটা পার্ট হতে পারে বায়োটেকনোলজি।

এই সেক্টরে প্রথম কোন উদ্যোগ ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৯৪-৯৫ সেশনে বায়োটেকনোলজি ডিসিপ্লিন চালু করা। এই বিশ্ববিদ্যালয় যত্নের সাথে প্রতিবছর মেধাবী গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং বায়োটেকনোলজিক্যাল উপায় ব্যবহার করে সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা সর্বক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে।

বাংলাদেশে এখন সরকারি এবং বেসরকারি প্রায় ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এনজিও, আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটির সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে বায়োটেকনোলজি সেক্টরে উন্নতি না হওয়ার অন্যতম কারণ উপযুক্ত লোক নিয়োগ না দেওয়া। বায়োটেকনোলজি গ্রাজুয়েটরা এসবক্ষেত্রে সঠিকভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না। বায়োটেকনোলজির এসব সেক্টরে ভিন্ন ডিসিপ্লিনের গ্র্যাজুয়েট নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজির বড় বড় যত প্রতিষ্ঠান আছে তার পলিসি মেকার বা প্রধানরা কেউ বায়োটেকনোলজির গ্রাজুয়েট নন। ফলে এই সেক্টরগুলোর আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না।

প্রশ্ন: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা কী ছিল? এই প্রতিষ্ঠান সেটা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে?

ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন: বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক উন্নতির জন্য এই প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনেক। বায়োটেকনোলজির প্রয়োজনীয়তা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। সারা পৃথিবীতে এখন বায়োটেকনোলজির বিপ্লব চলছে। বিংশ শতাব্দী ছিল কম্পিউটারের যুগ আর বর্তমানে চলছে বায়োটেকনোলজির যুগ। দেশের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান- সব ধরণের চাহিদার জোগান দেওয়াই বায়োটেকনোলজির উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ সরকার বায়োটেকনোলজিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এবং বায়োটেকনোলজি সংক্রান্ত গবেষণার পরিধি বৃদ্ধির জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করে। এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান সফল নয় বলব না তবে এর প্রতিষ্ঠার যে উদ্দেশ্য তা এখনো পূরণ হয়নি। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো এনআইবি প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজির গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে কিন্তু সেখানে মহাপরিচালক হিসেবে এখন পর্যন্ত বায়োটেকনোলজির কোন গ্র্যাজুয়েট নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

প্রশ্ন: অভ্যুত্থানের পরের নতুন বাংলাদেশে বায়োটেকনোলেজিকে কেমন দেখতে চান?

ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন: ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। বৈষম্যকে দূর করার জন্য এই আন্দোলন। বায়োটেকনোলজির গ্রাজুয়েটরা বৈষ্যমের শিকার হচ্ছে শুরু থেকেই। এজন্য এই খাতে উন্নতি সম্ভব হচ্ছে না। আমি আশাবাদী এই বৈষম্য দূর হলে বায়োটেকনোলজি সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যে উদ্দেশ্য নিয়ে চালু হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ তার সুফল ভোগ করতে পারবে। আমি মনে করি বায়োটেকনোলজি যত সেক্টর আছে সব জায়গায় যদি বায়োটেকনোলজি গ্রাজুয়েটদের মূল্যায়ন করে সঠিক নিয়োগ করা হয়, তাহলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বায়োটেকনোলজিরও উন্নতি আসবে।

প্রশ্ন: বায়োটেকনোলজি জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কোন কোন সেক্টরের উদ্যোক্তা হওয়া যায়?

ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন: বায়োটেকনোলজিতে পড়াশোনা করে শুধু চাকরি খুঁজতে হবে এরকম নয়। জীবপ্রযুক্তির জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তাও হওয়া সম্ভব। সারা পৃথিবীতেই এটি হচ্ছে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় যেসকল বিষয় সেসব সেক্টরেই জীবপ্রযুক্তির জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব। যেমন: কৃষি সেক্টর, চিকিৎসা ক্ষেত্র ইত্যাদি। বায়োটেকনোলজি এবং কম্পিউটারকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশে এই সেক্টরে যথোপযুক্ত পলিসি না থাকায় আমরা এই সেক্টরে সেরকম উদ্যোক্তা পাচ্ছি না।

প্রশ্ন: বায়োটেকনোলজির নতুন শিক্ষার্থীদের কী পরামর্শ দিবেন?

তাদের উদ্দেশ্যে বলব নিজেকে বায়োটেকনোলজিস্ট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হবে এবং সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। চাকরির চিন্তা না করে উদ্যোক্তা হতে হবে। দেশের কল্যাণে কাজ করতে হবে।

এসআই/

spot_img
spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ প্রকাশিত

spot_img