এক অদ্ভুতূড়ে ঘটনার ভেতর দিয়া সিরাজ শিকদার আবারও আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হইছেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়, ভারতীয় আধিপত্যবাদের সহিংস বিরোধীতা, মুজিবের বিরোধীতা এবং মুজিবের আমলে ক্রসফায়ারের শিকার হওয়া- এইসব কিছুই ঘুরে ঘুরে আসছে। যেহেতু সংবিধান নিয়ে নানাবিধ বাহাসের কাল আমরা পার করছি, আমি বাহাত্তরের সংবিধান নিয়া সিরাজের অবস্থান নিয়া এক দুইটা তথ্য জানান দিতে চাই।
বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ণের প্রক্রিয়া এবং মূলনীতি নিয়া একেবারেই গোড়াতেই যারা সমালোচনা তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সিরাজ শিকদার সম্ভবত সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। তার আক্রমণের ভাষা ছিল তীব্র।
তিনি প্রথমেই বলেছিলেন, যারা সংবিধান প্রণয়ন করছেন তাদের এটা ‘প্রণয়নের কোনো অধিকার তাদের নেই’। কারণ তারা নির্বাচিত হয়েছিলেন ‘ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া সামরিক দস্যুর নির্বাচনী কাঠামোর নির্দেশ (এলএফও) মেনে’।
এরপর একে একে তার সমালোচনাগুলা তুলে ধরেন। তবে, সংবিধানের ফাংশনাল অংশ নিয়ে অবশ্য খুব একটা মন্তব্য করা হয়নি। তার সমালোচনার প্রধান জায়গা ছিল, এই সংবিধান এমনভাবে বানানো হচ্ছে তাতে ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ’, ‘সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ এবং ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ ও তাদের দালালদের শোষণ ও লুণ্ঠন যেন বজায় রাখা যায়।
জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের ওপর পরিচালিত জাতীয় নিপীড়নের অবসানের কোনো কথা সংবিধানে নেই বলে তিনি যেমন সমালোচনা করেছিলেন, তেমনি বলা হয়েছিল, ‘এ সংবিধানে উর্দু ভাষাভাষী জনগণের ওপর পরিচালিত নিপীড়নের অবসানের কোনো কথা নেই।’
তিনি সম্ভবত প্রথম (এর আগে আমি কাউকে বলতে দেখিনি বা পড়িনি) সংবিধানের রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে ‘মুজিববাদ’কে গ্রহণ করার সমালোচনা করেছিলেন। তার কাছে ‘মুজিববাদ’ মানে ছিল ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ’।
সংবিধানের চারনীতির বিষয়ে বলেছিলেন: ‘এ সংবিধানে যে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব, যে সমাজতন্তের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে ছয় পাহাড়ের শোষণ ও লুন্ঠন, যে জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা এবং ঊর্দু ভাষাভাষী ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর জাতীয় নিপীড়ন, যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে পূর্ববাংলার মুসলিম জনগণের উপর ধর্মীয় নিপীড়ণ পরিচালনা। ‘
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার আসল মানে কী এইটার চাইতে তার কাছে জরুরি বলে মনে হয়েছিল, এইগুলা দিয়া আসলে কী করতে চাওয়া হচ্ছে, সেই রাজনীতিকে খোলাসা করা। ফলে বলেছিলেন, ‘পার্লামেন্সট ও বিচারালয় হচ্ছে এই ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বকে ন্যায়সঙ্গত করার স্থান বিশেষ’।
সিরাজ শিকদারের এই রচনা প্রকাশিত হইছিল ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে। সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ৪ নভেম্বর।
আজকে যখন বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে চারিদিকে আলাপ চলছে, তখন সিরাজ শিকদারকেও আমরা স্মরণ করবো সেই ক্রিটিকের একেবারে সূচনাবিন্দুর অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসাবে। সিরাজসহ আরও বহুজন বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে যে সমালোচনার ধারা শুরু করেছিলেন, তার এক দীর্ঘযাত্রা শেষে আমরা চব্বিশে এসে দাড়াইছি, বলা যায় আজকের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যন্ত দাড়াইছি।
এইটাও একটা ছোট কইরা বলে যাই। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এখনোও সংবিধানের চার মূলনীতি ঠিকঠাক রাখার পক্ষেই মতামত দিচ্ছে। মানে, সবাইকে এক কাতারে ফেইলা বিচার করতে যাইয়েন না।
লেখক: সহুল আহমদ
লেখক, অনুবাদক ও অ্যক্টিভিস্ট