ধর্ষণ শুধু একটি অপরাধই নয়, এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধি আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ব্যাধি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যেকারণে পত্রিকার পাতা খুললে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রতিটি রিফ্রেশে ধর্ষণের খবর চোখে ভাসে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুসারে, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ১১ হাজার ৭৫৮ জন নারী ও মেয়ে শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৬ হাজার ৩০৫ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি মাগুরায় ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় পুরো দেশ এখন উত্তাল পরিস্থিতিতে। এছাড়াও স্কুলে ছাত্রী ধর্ষণ, নানুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার, ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষনের শিকার তরুণী। এরকম অহরহ ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে মেয়ে শিশুরা এই সহিংসতার শিকার বেশি হচ্ছে। এসব দেখলে মনে হয় যেন সারাদেশে একযোগে ধর্ষণের প্রতিযোগিতা চলছে।
কেন এত ধর্ষণ?
দেশে এত ধর্ষণের কারণ কী? এই প্রশ্নটি যখন উঠে তখন বিভিন্ন পক্ষ থেকে শুরু হয় নানা যুক্তি তর্ক। এক পক্ষ বলে নারীর অশালীনভাবে অবাধ চলাফেরাই ধর্ষণের জন্য দায়ী। আবার আরেকপক্ষ বলে বোরকা হিজাব পরেও মাদ্রাসা ছাত্রী কেন ধর্ষণের শিকার হয়? শিশু কেন ধর্ষণের শিকার হয়? একে অপরের যুক্তি তর্ক চলতে থাকে। কিন্তু ধর্ষণ থামে না। মূলত এর পেছনে আমাদের বিকৃত মানসিকতা, সমাজব্যবস্থা, বিকল আইনব্যবস্থা এবং যথাযথ শাস্তি প্রয়োগ না করা অধিকাংশভাবে দায়ী।
অন্যান্যা দেশে ধর্ষণের শাস্তি কেমন?
ভারত : ভারতে ধর্ষণের শাস্তি কঠোর এবং অপরাধের প্রকৃতি ও পরিস্থিতির ভিত্তিতে ভিন্নতা রয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির (আইপিসি) ৩৭৬ ধারায় ধর্ষণের জন্য ন্যূনতম ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে, যা আজীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। তবে, শিশু ধর্ষণ বা গণধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি আরও কঠোর হতে পারে।
পাকিস্তান : পাকিস্তানের ফৌজদারি আইন অনুযায়ী ধর্ষণ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। ভারতের মত পাকিস্তানের আইনেও ধর্ষণ প্রমাণিত হলে সর্বনিম্ন ১০ বছর কারাদণ্ডের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এছাড়া দুই বা অধিক ব্যক্তি একই উদ্দেশ্য নিয়ে ধর্ষণের মত অপরাধ সংঘটন করলে বা সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করলে, প্রত্যেকের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে পাকিস্তানের পেনাল কোডে।
চীন : চীনে ধর্ষণ একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। চীনের দণ্ডবিধি অনুসারে, ধর্ষণের জন্য শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বা ৩-১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। বিশেষ করে, যদি ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি গুরুতর আঘাত পায় বা মৃত্যু ঘটে, তবে দোষী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডের আওতায় আসতে পারে। আবার কিছুক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে লিঙ্গচ্ছেদ ও করা হয়ে থাকে।
রাশিয়া : রাশিয়ার দণ্ডবিধি অনুসারে সাধারণ ধর্ষণের জন্য রাশিয়ার দণ্ডবিধি অনুযায়ী ৩ থেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। যদি ধর্ষণের ফলে গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হয় বা শিকার ব্যক্তি শিশু বা অক্ষম হয়, তবে শাস্তি আরও কঠোর হতে পারে। এতে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। এছাড়া ধর্ষণের পর যদি ভিক্টিমকে হত্যা করা হয়, তবে দোষী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
সৌদি আরব : সৌদি আরবে ধর্ষণের বিচারের জন্য শাস্তি আরোপের ক্ষেত্রে ইসলামিক আইন বা শরিয়ার বিধান প্রয়োগ করা হয়। ইসলামী আইনের অধীনে আদালত ধর্ষকের উপর চাবুক মারা থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তি আরোপ করতে পারে।
ইরান : ইরানে ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং ইসলামী শরিয়াহ আইন অনুযায়ী এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। ইরানের দণ্ডবিধি অনুসারে, ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে, শাস্তির মাত্রা নির্ধারণে আদালত অপরাধের প্রেক্ষাপট, প্রমাণের মান, এবং অন্যান্য বিবেচনাসমূহকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশে কী করণীয়?
অন্যান্য দেশে ধর্ষণের জন্য কঠোর আইন যেমন রয়েছে, তেমন প্রয়োগ ও করা হয়। বাংলাদেশে ২০২০ সালে সংশোধনী আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে প্রয়োগ হয়নি। এই আইন কার্যকর করতে হবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত করে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করতে হবে। এমনভাবেই শাস্তি প্রদান করতে হবে যেন সবার কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। আর নাহলে বাংলাদেশের মতো দেশে কঠোর শাস্তি প্রদান ছাড়া শুধু নীতি নৈতিকতার কথা বলে ধর্ষণ ঠেকানো কখনও সম্ভব হবে না।
লেখক : মোস্তাফিজুর রহমান রাফি
শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
/ইএইচ