ড. কামরুল হাসান মামুন: ফিল্ডস মেডেল অ্যাওয়ার্ড জয়ী ইরানিয়ান বংশোভূত মার্কিন গণিতবিদ ২০০৪ সালে গণিতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে Clay Mathematics Institute-এ পোস্ট-ডক ফেলো হিসাবে ১ বছর কাজ করে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই পদে থাকেন। তার প্রভাষক হিসাবে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নাই বলে তার সহকারী অধ্যাপক হতে কোনো সমস্যা হয়নি।
২০০৮ সালে তিনি সরাসরি সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ পান। অর্থাৎ পিএইচডি শেষ করে ৪ বছরের মধ্যে পূর্ণ অধ্যাপক হয়ে যান। তাকে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে ৪ বা পাঁচ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার দরকার হয়নি। তারাতো বলেনি ১২ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছাড়া অধ্যাপক করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কি তা সম্ভব? আমাদের এখানে বয়স এবং শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাকে কোনো প্রকার যোগ্যতা দিয়ে অতিক্রম করা যায় না। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয় শুনুন তাহলে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য যোগ্যতা হলো পিএইচডি থাকতে হবে, ১২ বছরের শিক্ষকতা ও গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং তম্মধ্যে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে ৪ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, স্বীকৃত গবেষণা জার্নালে ১২টি আর্টিকেল থাকতে হবে।
তেমনি সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার জন্য পিএইচডি না থাকলেও চলবে। শুধু মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা যার মধ্যে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা লাগবে। আর পিএইচডি থাকলে মোট ৭ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে যার মধ্যে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ৩ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আর মোট ৭টি প্রবন্ধ স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত থাকতে হবে।
এখন ধরুন কারো ৪০ কিংবা ৫০টি গবেষণা প্রবন্ধ আছে যার মধ্যে কয়েকটা নেচার বা সাইন্স জার্নালে, কয়েকটা ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্সের মত জার্নালে সহ খ্যাতিমান জার্নালে ৫০টি বা তারও বেশি আছে। কিন্তু অধ্যাপক হওয়ার জন্য ১২ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসহ সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে ৪ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নাই। অথবা সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার জন্য মোট ৭ বছরের শিক্ষকতাসহ ৪ বছরের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নাই। আছে একটা পিএইচডি ডিগ্রী আর আছে দুই বা তিনটা জায়গায় পোস্ট-ডকের অভিজ্ঞতা।
বোঝাই যাচ্ছে তিনি একজন অসাধারণ গবেষক। পিএইচডি’র পর একাধিক পোস্ট-ডক ফেলোশিপ পাওয়াও তার যোগ্যতার স্বীকৃতি। এই রকম যোগ্য মানুষদের স্বীকৃতির ব্যবস্থা রাখতে হয় নচেৎ যোগ্য মানুষ তৈরি হয় না। এই ব্যতিক্রমী মানুষের নিয়োগের ব্যবস্থা না থাকলে কখনোই উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় হবে না।
সমস্যা হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যতিক্রমী উচ্চমানের শিক্ষক বা গবেষকদের ধারণ করতে পারে না। তাই তারা চায় না ব্যতিক্রমী উচ্চমানের কেউ আসুক। কোনও কারণে সিস্টেমে ঢুকে গেলেও তাদেরকে এমনভাবে কর্নারড করে রাখবে যেন দুইদিন পর অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য হয়। আর যারা অন্যত্র না যাবে তাকে লানত বা অভিশপ্ত জীবন যাপন করতে হবে।
আমাদের সময়ের কিংবদন্তিতুল্য এক ছাত্র ছিল। সে ইতালি, আমেরিকা ও অক্সফোর্ডে পড়াশুনা শেষে স্বেচ্ছায় দেশে চলে এসেছিল। তারপর ইতিহাস। তার মেধার যেই ধার ছিল সেটাকে এই রাষ্ট্রতো কাজে লাগাতেই পারেনি উল্টো পরিবেশের কারণে তার ধারও কমে এসেছে। এই রকম আরেক ধারওয়ালা মানুষ তৈরি করেছিল আমেরিকা। বাবার কথায় আমেরিকা ছেড়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। তাকেও তার প্রতিষ্ঠান যেইভাবে নিষ্পেষিত করছে তা বর্ণনাতীত। এমনকি অধ্যাপক ইউনূসের কথাই ভাবুন না। সারা পৃথিবীর মানুষ তাকে মাথায় তুলে রাখে এমনকি ভারতও। অথচ নিজ জন্মভূমি তাকে পাতালে পাঠাতে ব্যস্ত।
এই দেশ ভালো ব্যতিক্রমী মেধাবীদের জন্য না। এই দেশ স্মার্ট চোর, স্মার্ট দুর্নীতিবাজ, স্মার্ট পাচারকারী, স্মার্ট ব্যাংক লুটকারীদের জন্য স্বর্গ। ইহাকে আমরা আদর করে স্মার্ট বাংলাদেশ বলি।
লেখক: ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এসআই/
মন্তব্য করুন