spot_img

রাষ্ট্র ও প্রশাসন সংস্কারের চ্যালেঞ্জ কীভাবে সামলাবে নতুন সরকার

এসম্পর্কিত আরো পড়ুন

বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশে ১১ দিন আগে গঠন হয়েছে নতুন সরকার। শুরু থেকেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে যে বিষয়টি বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে, তা হচ্ছে রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ভেতরে দীর্ঘদিনের অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার তথ্য সামনে আসছে।

- বিজ্ঞাপন -

প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পদে আসীনদের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ হচ্ছে, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা নিজেরাই দায়িত্ব ছেড়ে পদত্যাগও করছেন। যদিও শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তনের সাথে সাথেই সেসব প্রতিষ্ঠানে সংস্কার কাজ শুরু হচ্ছে, তা নয়।

ফলে দীর্ঘ আকাঙ্খিত রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর সংস্কারের দাবির সাথে এসব পদত্যাগের সংযোগ কতটা রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু, বহু বছর ধরে যেভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কাজ করে আসছে তার বিপরীতে সংস্কারের ক্ষেত্রে ঠিক কী ধরণের বাধা আসতে পারে? আর কীভাবেই বা রাষ্ট্র ও প্রশাসন সংস্কারের চ্যালেঞ্জ সামলাবে নতুন সরকার?

রাষ্ট্র সংস্কার

নয়ই অগাস্ট প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও বর্তমান উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর সংস্কারের কথা।

সেদিন রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন আরেক উপদেষ্টা আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও। সুশাসন, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারার মতো প্রত্যাশার কথাও উঠে এসেছে সেখানে।

এদিকে, যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেড় যুগের আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, তার সূত্রপাতটা ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি দিয়ে। তবে শুরুতে অরাজনৈতিক এবং অহিংস আন্দোলন দিয়ে শুরু হলেও, শেষ পর্যন্ত ব্যাপক রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এখন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে একটা বড় দায়িত্ব এসে পড়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের। আর তার পরিসরও অনেক ব্যাপক।

এক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত দিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এমন অনেক দিকই রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি আসছে। আর সংবিধান এবং আইনের অনেক বিষয়ও এখানে সম্পৃক্ত। মোটাদাগে সুশাসন ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার একটা বড় আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে।

বাংলাদেশের সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান মনে করেন, অনেক ক্ষেত্রেই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব মি. খান বলছেন, সংস্কারের কাজটি বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে নতুন সরকারের জন্য।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রযন্ত্রকে মানবিক, গণতান্ত্রিক করতে প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী, রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে যত কর্মচারী যুক্ত আছেন – জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যাদের বেতন-ভাতা হয়, তাদেরকে জনগণের কল্যানের জন্য প্রস্তুত করা এবং পুরো ব্যবস্থাটাকে সংস্কার করার মতো চ্যালেঞ্জিং কাজটা সরকারকে করতে হবে।”

মি. খানের মতে, “অতীতে কোনও রাজনৈতিক সরকার এটি করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না, তাই এই সরকারকেই সেসব সংস্কার করতে হবে।”

তবে, বিভিন্ন সময় যে সংস্কারের নানা পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ ছিল না তা নয়। এর মাঝে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়কার প্রশাসনিক পরিবর্তনগুলোকে গুরুত্ব সহকারে দেখেন অনেক বিশ্লেষক। কিন্তু এবারের মতো এত বড় পরিসরে প্রায় সবক্ষেত্রে সংস্কারের প্রসঙ্গ কখনো আসেনি।

এছাড়া রাজনৈতিক সরকারের বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিক থেকে ধরলে ২০০৬ সালের পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল।

এর মাঝে নাগরিকদের পরিচিতি চিহ্নিত করতে বায়োমেট্রিক আইডেনটিফিকেশন, জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো বেশ কিছু নতুন বিষয় আসে। তবে পুরো রাষ্ট্রের সংস্কারের মতো বিষয়ে তেমন পদক্ষেপ কিছু দেখা যায়নি।

সংস্কারের পথে যতো বাধা বা চ্যালেঞ্জ

রাষ্ট্র সংস্কার বা এর অন্তর্ভুক্ত প্রশাসনিক সংস্কার খুব কম সময়ে সম্ভব না বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। সংস্কারের জন্য এটাকে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “পুরো ব্যবস্থার খোলনলচে বদলানোর অনেক কিছুই সংবিধানের সাথে যুক্ত। আর, কাঠামোগত দিক দিয়েও মানুষের আচরণ, রেগুলেশন বা প্রবিধান, নিয়মকানুন পরিবর্তনের বিষয় সময়সাপেক্ষ বিষয়।”

“সে সময়টা বেশি লাগলে – তখন মানুষের মধ্যে যেমন অধৈর্যের প্রবণতা তৈরি হতে পারে, একই সাথে রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো থেকেও চাপ তৈরি হতে থাকবে,” বলেন তিনি।

ফলে কম সময়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়ার একটা চাপ বর্তমান সরকারের থাকবে। রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপ মোকাবেলা করা এবং বিভিন্ন মতের মানুষকে একত্র করে সেগুলো সামাল দেয়াও এই চ্যালেঞ্জের আরেকটা অংশ।

অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেছেন, ইতোমধ্যেই বিএনপির তরফ থেকে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। যত ধরণের সংস্কারের আলোচনা আসছে তা এই সময়ের মধ্যে সম্ভব না, ফলে এমন দিকগুলোও সামাল দেয়ার ব্যাপার রয়েছে।

“এর বাইরেও বেশ কয়েক ধরণের বাধা রয়েছে, যেমন যেখানে সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়া হবে তার ভেতর থেকে একরকম প্রতিরোধ বা বাধার জায়গা তৈরি হওয়া।”

অধ্যাপক ইসলাম বলেন, “পরিবর্তন আনতে গেলে অনেকের স্বার্থ বা আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হবে, ফলে এর ভেতর থেকে ভেতর থেকেও চাপও সৃষ্টি হবে।”

আবার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার যে আলোচনা বা দাবি মানুষের রয়েছে, সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে বলে আংশংকা করেন কেউ কেউ।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক জায়েদা শারমিন বলেন, “দীর্ঘদিনের একটা সিস্টেমের সাথে যারা অভ্যস্ত, তাদেরকে হঠাৎ করে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়া, সে মানসিকতার বা নিয়মের পরিবর্তনটা মেনে নিতে মানুষের সময় লাগে, এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।”

এছাড়া দীর্ঘদিনের প্রায় সব রাজনৈতিক সরকারের গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে কাজ করতে না দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন অধ্যাপক শারমিন।

“আমাদের এখানে শুধু রাজনৈতিক দল পরিবর্তন হয়েছে, সিস্টেম্যাটিক পরিবর্তন, বৈপ্লবিক বা চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন কখনওই আমাদের এখানে হয়নি। সচিবালয় থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ, সংসদীয় চর্চা, সব ক্ষেত্রেই নিয়মকানুন থাকলেও এর চর্চা দেখা যায়নি,” বলেন তিনি।

প্রায় অর্ধশতকের এমন প্রবণতা থেকেও বের হয়ে আসার চ্যালেঞ্জও রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

এছাড়া বর্তমানে দেশের নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলে সব খাতে পরিবর্তন করার মতো সম্পদ বা বিনিয়োগের দিকও একটা বড় বিষয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

“বর্তমান রিজার্ভ পরিস্থিতি, বাজেট পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সাথে সাথে অর্থনীতি গতিশীল রাখা, জনজীবনে স্বস্তি তৈরি করা সেসবের পাশাপাশি পরিবর্তনের জন্য ‘যথেষ্ট রিসোর্স মোবিলাইজ’ করাটা চ্যালেঞ্জের কথা,” বলেন অধ্যাপক ইসলাম।

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলছেন, নানা বাধাআর চ্যালেঞ্জ থাকলেও এখন সংস্কার করাটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন “সংস্কার ছাড়া আমরা আর কোনও ফ্যাসিবাদের হাতে পড়তে চাই না।”

করনীয় কী

অনেক রকমের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশার মধ্য দিয়ে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের হাতে পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। চ্যালেঞ্জ উৎরে পরিবর্তন আনতে কিছু দিকে নজর দেয়ার কথাও বলা হচ্ছে।

যেমন আবু আলম মো. শহীদ খানের মতে, প্রথমত রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে যারা ‘খুবই দলকানা’ বা অতিরিক্ত দলীয় প্রভাবে থাকাদের পরিবর্তন, অপরাধের অভিযোগ থাকলে তদন্ত ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত কীভাবে সংস্কার হবে সে পদ্ধতি নির্ধারণ করা। যেমন পুলিশ ষ্টেশন কীভাবে জনগণের জন্য কাজ করবে, সরকারি অফিস, মাঠ পর্যায়ের অফিস, বিচার বিভাগ কীভাবে আরও ভালোভাবে কাজ করবে, প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা সৃষ্টি – এমন বিষয়গুলো নিয়ে সে সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করার কথা বলেন তিনি।

অধ্যাপক মারুফুল ইসলামের মতে, যে কোনও পরিবর্তন বাস্তবায়ন করতে সবার আগে আস্থার জায়গা তৈরি করা প্রয়োজন।

যাদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে তাদের মধ্যে আস্থার এবং আত্মবিশ্বাসের জায়গা তৈরি করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনা করে তাদেরকে সম্পৃক্ত করার দিকে জোর দেন তিনি।

এছাড়া পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে অপব্যবহার করার মতো যে কোনও শক্তির ব্যপারে সতর্ক থাকার কথাও বলেন তিনি।

“আমরা সবাই মিলে কাজটা করতে পারবো, সবার কথা শোনা হবে – এই আস্থা তৈরি হলে আমার ধারনা কাজটা দুরূহ না। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন হয়েছে। প্রসব যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সন্তান ভূমিষ্ট হয়, যা আমাদের আকাঙ্ক্ষা, এই প্রসব যন্ত্রণা কিছু থাকবে সেটা আমাদের মানতে হবে,” বলেন অধ্যাপক ইসলাম।

অবশ্য অধ্যাপক জায়েদা শারমিন মনে করেন, দীর্ঘ দিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার পরিবর্তন বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং এখনই এ বিষয়ে বলা যায় না।

তবে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি তুলছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই সময়ের মধ্যে পরিবর্তনের মতো তেমন কিছু সম্ভব হবে না।

এসআই/

spot_img
spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ প্রকাশিত

spot_img