সাদিকুল ইসলাম: কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মো, মাহফুজ আলম। নিয়োগ পেয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেবে। এরপর থেকেই তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই তাকে নিয়ে ফেইসবুকে ও গুগলে সার্চ করছেন- কে এই মাহফুজ আলম।
গত বুধবার (২৮ আগস্ট) রাতে মাহফুজ আলমকে নিয়োগ দিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মাহফুজ আলমকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্মসম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকেই সবাই মাহফুজের সম্পর্কে জানতে গুগল-ফেসবুকের সহায়তা নিচ্ছেন।
ফেসবুক শুধু মাহফুজ (ইংরেজিতে) লিখলেই অটো চলে আসে মাহফুজ আবদুল্লাহ (মাহফুজের ফেসবুক একাউন্টের নাম)। নিচে লেখা উঠে ‘পপুলার নাও’ অর্থ্যাৎ এই নামে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেশি সার্চ হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ে ফ্রন্ট লাইনে তাকে তেমন একটা দেখা যায়নি। তবে কোনও কোনও গণমাধ্যমে তিনি আলোচনায় এসেছে ‘অজ্ঞাত ইন্টেলেকচ্যুয়াল তুরণ’ হিসেবে। বলা হয়ে থাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বা তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ডিজিএফআই ও এনএসআই’র মতো রাষ্ট্রীয় বাঘা গোয়েন্দা সংস্থাও তার পরিচয় উদ্ধার করতে পারেনি।
তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক হিসেবেও কাজ করেছেন। এখন নিয়োগ পেয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেবে।
মাহফুজ আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৫–১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তিনি বাংলাদেশের খ্যাতনামা তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রসা থেকে এইচএসসি (আলিম) পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ইসাপুর গ্রামে।
মাহফুজ আলমের ফেসবুক একাউন্ট ঘেটে দেখা যায়, তার জন্মদিন ৩১ জানুয়ারি। লেখালেখির অভ্যাসও রয়েছে মাহফুজের। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও সমকালীন জনমত’ নামের দুই খণ্ডের বইও প্রকাশিত হয়েছে তার নামে।
গত ৯ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ফেসবুক একাউন্টে এক পোস্টে মাহফুজ আলম সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ছাত্র বিপ্লবের পেছনের মস্তিষ্ক ছিলেন মাহফুজ। মাহফুজ ব্রিটিশ ভারত বিভাজনের পর থেকে আমাদের সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক বসতি সম্পর্কে জানেন। দেশের সব রাজনৈতিক নেতার মানসিক মেকআপ তিনি জানেন। রাজনৈতিক ঘটনা এবং কেন তারা সফল বা ব্যর্থ হয়েছে সম্পর্কে তার বিশ্বজনীন জ্ঞান আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি সংক্ষিপ্ত সাংবাদিকতার কাজ করেছিলেন। ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনে আখতার হোসেন বা আকরাম হোসেনসহ তার বন্ধুরা ব্যাপকভাবে জড়িত ছিল। মাহফুজ ঘনিষ্ঠ ছিলেন কিন্তু কোনো দলেরই ছিলেন না।’
তিনি আরো লেখেন, হাসিনাকে উৎখাত করার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে মাহফুজেরও বড় ভূমিকা ছিল। সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করা ছাত্র আলোচনা দলে ছিলেন তিনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্যাবিনেটে গ্রহণযোগ্য লোক ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগ ছাড়া সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তারা আলোচনা করছিল। মাহফুজ মনে করে তার কাজ এখনো শেষ হয়নি। তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে এবং রাজ্যের চেক ও ভারসাম্য নিশ্চিত করে এমন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করতে চায়। ছাত্র হত্যার সময় হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনীর সকল হত্যাকাণ্ডের নথিপত্রও দিতে চায় তারা। এই মুহূর্তে মাহফুজ বিয়ে করে তার মাস্টার্স শেষ করতে চায়। সে এখনও তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। আমি যখন রাত ১টার দিকে তাকে ফোন করেছিলাম, সে বলল দীর্ঘ ঘুমের পর সে এইমাত্র জেগেছে। “আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের সামনে একটি দীর্ঘ এবং কঠিন যাত্রা আছে’ তিনি বলেন। ‘কিন্তু প্রথমে আমার একটু ঘুম দরকার’ বলেও যোগ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী রবিউল রাফি ফেসবুকে লিখেছেন, মাহফুজ আলম ২৪ এর আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড এবং সমন্বয়কদের সমন্বয়ক।
তিনি লিখেন, ‘মাহফুজ আলম আমাদের সবার পরিচিত ফেইস। চুপচাপ এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের মাহফুজ ভাইকে দেখতাম হলের পুকুর পাড়ে বসে থাকতে, চুপচাপ জামাই এর দোকানে খাবার খেতে। দীর্ঘ ৬-৭ বছরের হল জীবনে কখনোই আলোচনায় আসার মত কিছু বলতে বা করতে দেখেনি কেউ।’
রবিউল রাফি আরো লেখেন, জুলাই বিপ্লবের শুরু থেকেই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এক নতুন ধরণের আন্দোলন কাঠামো তৈরি করতে করতে এগিয়েছে। যার সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন কখনোই পরিচিত ছিল না। সাধারণত যে কোন আন্দোলন আহবাহক কমিটি দ্বারা পরিচালিত হলেও এইবারের আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ডিকশনারিতে যোগ করেছে নতুন শব্দ ‘সমন্বয়ক’। এরপরে একের পর এক যোগ করেছে আরো নতুন নতুন টার্মিনোলজি- ‘বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাটডাউন, মার্চ ফর ঢাকা’ এই ধারণাগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আগে কখনো দেখেনি। ছয় সমন্বয়ক ডিবি হেফাজতে, তবুও আসতে থাকে একের পর এক কর্মসূচি। জীবনকে তুচ্ছ করে তাতে যোগ দেয় আপামর ছাত্র জনতা। সফল হতে থাকে প্রতিটা কর্মসূচি। কিভাবে কে কোথায় বসে তৈরী করত এই রূপরেখা? এই চিন্তা আমার মাথায় তখন থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সম্প্রতি ড. ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেব নিয়োগ প্রদান করে মাহফুজ ভাইকে প্রকাশ্যে আনার মাধ্যমে সেই জট টা খুলতে শুরু করেছে।
তিনি আরো লেখেন, মাহফুজ আলম ভাই আমার হলের আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র। আমাদের সবার পরিচিত ফেইস। চুপচাপ এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের মাহফুজ ভাইকে দেখতাম হলের পুকুর পাড়ে বসে থাকতে, চুপচাপ জামাই এর দোকানে খাবার খেতে। দীর্ঘ ৬-৭ বছরের হল জীবনে কখনোই আলোচনায় আসার মত কিছু বলতে বা করতে দেখেনি কেউ। কিন্তু হটাৎই আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসলেন।’
এসআই/
মন্তব্য করুন