এডুকেশন টাইমস ডেস্ক: হিজরি সনের সফর মাসের শেষ বুধবারকে আখেরি চাহার শম্বা বলে। এ বছর ৪ সেপ্টেম্বর সেই বুধবার আসবে। আরবিতে আখেরি অর্থ শেষ এবং ফার্সিতে চাহার শম্বা অর্থ বুধবার; অর্থাৎ আখেরি চাহার শম্বা অর্থ শেষ বুধবার।
সফর মাসের শেষ বুধবারকে ফার্সি ভাষায় আখেরি চাহার শম্বা বলা হয়।
সফর মাসের শেষ বুধবারে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রচণ্ড অসুস্থতা থেকে সুস্থতা অনুভব করলে সাহাবিরা খুশি হয়ে দান সদকা করেন ও শুকরিয়া আদায় করেন বলে মত পাওয়া যায়। এ জন্য কিছু দেশে এদিনে দান সদকাসহ বিভিন্ন নফল ইবাদত করেন ধর্ম প্রাণ মুসলমানগণ।
বাংলাদেশে এ দিবস উপলক্ষ্যে বার্ষিক সরকারি ছুটির তালিকায় একটি ছুটি ঐচ্ছিক ছুটি হিসেবে উল্লেখ আছে। বাংলাদেশে এ দিবস পালন নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্যও দেখা যায়।
কারও মতে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন দিনে সুস্থ হয়েছিলেন, কোন অসুস্থতার পর সুস্থ হয়েছিলেন ইত্যাদি স্পষ্ট করে ইতিহাসে বর্ণিত নেই। আবার নবীজি (স.)-এর মৃত্যুর পর কোনো সাহাবি এই দিবস পালন করতেন না। তাই এই দিবস পালনে তারা নিরুৎসাহিত করেন।
যারা এই দিবস পালন করে থাকেন তারা দুই সময়ের অসুস্থতার কথা বলে থাকেন। কেউ বলেন সপ্তম হিজরিতে নবীজি (স.)-এর জাদুতে আক্রান্ত হওয়ায় অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর সফর মাসের শেষ বুধবারে সুস্থ হয়ে যান।
আবার কেউ কেউ বলেন নবীজি (স.) মৃত্যুর আগে যে অসুস্থ হয়েছিলেন সে সময় মৃত্যুর আগে সফর মাসের শেষ বুধবারে সুস্থতা অনুভব করেন এবং মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। এ সময় হজরত আবু বকর (রা.)-কে ইমামতির দায়িত্ব দেন তিনি। সে বুধবারের পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।
অসুস্থতার সময় যেটাই হোক নবীজি (স.) সুস্থ হওয়ার পর যখন মসজিদে আসেন তখন সাহাবায়ে কেরাম অনেক আনন্দিত হন এবং শুকরিয়া স্বরূপ দান সদকা করেছিলেন।
বর্ণিত আছে, আবু বকর (রা.) খুশিতে ৭ হাজার দিনার এবং ওমর ইবনে খাত্তাব ৫ হাজার দিনার, ওসমান ১০ হাজার দিনার, আলী ৩ হাজার দিনার, আবদুর রহমান ইবনে আওফ ১০০ উট ও ১০০ ঘোড়া আল্লাহর পথে দান করেছিলেন। এরপর থেকে মুসলমানরা সাহাবিদের নীতি অনুকরণ ও অনুসরণ করে আসছে।
এসব বর্ণনা ‘বারো চান্দের ফজিলত’ ও ‘রাহাতুল কুলুব’ ইত্যাদি বইয়ে বলা আছে। তবে উল্লিখিত কিতাব দুটিতে বর্ণিত ও বহুল প্রচলিত সফর মাসের শেষ বুধবারের বিষয়টিকে ইসলামি পণ্ডিত ও গবেষকগণ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন।
তাদের বক্তব্য হলো, রসুলুল্লাহ (সা.) অসুস্থ হওয়ার দিনক্ষণ নিয়ে যথেষ্ট ইখতিলাফ থাকায় নির্দিষ্ট কোনো দিনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অথচ রসুল (সা.)-এর অসুস্থতাজনিত বর্ণনা অসংখ্য হাদিসে রয়েছে, তবে কোথাও দিন-তারিখ নির্দিষ্ট করে উল্লেখ নেই। তা ছাড়া প্রখ্যাত তাবেয়ি ইবনে ইসহাক বলেন, ‘রসুলুল্লাহ (সা.) যে অসুস্থতায় ইন্তিকাল করেন, সেই অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষ কয়েক রাত থাকতে অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে।’ (ইবনে হিশাম, সিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ: ৪/ ২৮৯)
এ ছাড়া, ইবনে হিশাম বিভিন্ন বর্ণনার আলোকে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর অসুস্থতার দিন ঠিক করেছেন ১৮ সফর থেকে একনাগাড়ে ১৩ দিন পর্যন্ত। (ইবনে হিশাম ৯৯৯) এই মতের মতোই হুবহু পাওয়া যায় ইসলামি বিশ্বকোষের ১৩ নং পৃষ্ঠায়।
শুধু তা-ই নয়, রসুলুল্লাহ (সা.) কোন দিন থেকে অসুস্থ হয়েছিলেন, সে বিষয়েও বিস্তর মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন শনিবার, কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার। এমনকি কত দিনের অসুস্থতার পর তিনি ইন্তিকাল করেন, সে বিষয়েও রয়েছে মতভেদ। কেউ বলেছেন ১০ দিন, কেউ বলেছেন ১২ দিন, কেউ বলেছেন ১৩ দিন, কেউ বলেছেন ১৪ দিন। এরপর তিনি ইন্তিকাল করেন। (জারকানি/শারহুল মাওয়াহিব-১২/ ৮৩; কাসতালানি, আহমদ ইবনে মুহাম্মদ, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া: ৩/ ৩৭৩)
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, রসুল (সা.)-এর ওপর জনৈক ইহুদির জাদুর প্রভাব ছিল হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে সপ্তম হিজরির মহররম মাসের প্রথম দিকে। এই জাদুর প্রভাব কোনো বর্ণনায় ছয় মাসের কথা এসেছে, আর কোনো বর্ণনায় এসেছে ৪০ দিনের কথা। সুতরাং সুস্থতার তারিখ কোনোভাবেই ১১ হিজরির সফর মাসের ‘আখেরি চাহার শম্বা’ বা ‘শেষ বুধবার’ হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রখ্যাত অনেক গবেষক আলেম। (ফাতহুল বারি: ৭/ ৭৪৮, কিতাবুল মাগাজি: ৪৪৪২, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪/ ১৯৩, সিরাতুন নবী, শিবলী নোমানী: ২/ ১১৩)
এ কথাও ঠিক নয় যে, বুধবারের পর সুস্থতায় কোনোরূপ উন্নতি হয়নি। বরং এরপর আরেক দিন সুস্থতা বোধ করেছিলেন এবং জোহরের নামাজ আদায় করেছিলেন। (বুখারি ৬৬৪, ৬৮০, ৬৮১; মুসলিম ৪১৮) এমনকি সোমবার সকালেও সুস্থতা অনুভব করেছিলেন, যার কারণে আবু বকর (রা.) অনুমতি নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। (সিরাতে ইবনে ইসহাক ৭১১-৭১২, আর রাওজাতুল উলুফ ৭/৫৪৭-৫৪৮)।
দিনটি যদি আমলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে এ দিনটি সম্পর্কে হাদিসে বা সাহাবিদের বর্ণনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতো। আর ধর্মীয় সব রীতিনীতি নির্ভরযোগ্য সনদে পাওয়া না গেলে সেটার অনুকরণ-অনুসরণ উম্মতের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।
কেউ যদি নিজের থেকে ভালো মনে করে ইবাদতের পদ্ধতি তৈরি করে সওয়াবের আশায় পালন করে তাহলে সেটা বিদআত হিসেবে পরিগণিত হয়। কেননা, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেউ যদি এমন কোনো আমল করে, যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।’ (বুখারি ২৬৯৭; মুসলিম ১৭১৮)
এসএস/
মন্তব্য করুন