spot_img

জুলাই বিপ্লব: তা’মীরুল মিল্লাত টঙ্গীর রক্তাক্ত অধ্যায়

এসম্পর্কিত আরো পড়ুন

মির্জা নাদিম, টঙ্গী: জুলাইয়ের গরম বাতাসের মতোই উত্তপ্ত ছিল সেদিনের রাজপথ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে শুরু হওয়া ছাত্রদের ন্যায়বিচারের দাবিতে গর্জে ওঠা স্লোগান মুহূর্তেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। বৈষম্য মুক্ত, সাম্যবাদী বাংলাদেশ— এটাই ছিল শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন।

১৫ জুলাই, সেই অভিশপ্ত দিন। যখন ক্ষমতার দম্ভে উন্মত্ত একদল অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ক্যাডার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। লোহার রড-পাইপ, লাঠি, পাথরসহ দেশীয় অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর। তাদের বর্বরতা থেকে রেহায় পায়নি ছাত্রীরা। রক্ত ঝরলো কিন্তু থামল না বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন। আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠল শিক্ষার্থীরা।

- বিজ্ঞাপন -

এদিকে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার বুঝতে পেরেছিলো, শুধু হামলা চালিয়ে এ আন্দোলন দমানো যাবে না। তাই ১৬ জুলাই শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন— সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ! বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে শিক্ষার্থীদের জোর করে বের করে দেওয়া হলো, কেউ পালিয়ে গেল, কেউ আশ্রয় নিল পরিচিত জনের বাড়িতে কিন্তু আন্দোলন থামলো না। বরং এবার দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়ে পড়লো স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাঝে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য সব জায়গার মতো ঢাকার উত্তরা তখন ছিল ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ১৬ জুলাই উত্তরা বিএনএস সেন্টারে জড়ো হলো হাজার হাজার শিক্ষার্থী। শুরুর দিকে বাধাগ্রস্ত হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা। পরবর্তীতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল-মাদ্রাসার হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা এসে প্রতিরোধ গড়ে তুলে রাজপথ দখলে নিয়ে নেয়। সেদিন উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে আন্দোলনে যোগদান করেন তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা টঙ্গীর হাজার  হাজার শিক্ষার্থী। আন্দোলন চলে প্রায় বিকাল ৫টা পর্যন্ত। পরবর্তীতে রাজলক্ষ্মী থেকে হাজার হাজার ছাত্ররা মিছিল নিয়ে হাউস বিল্ডিং গিয়ে সেদিনের কর্মসূচি সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

সেদিন তা’মীরুল মিল্লাত টঙ্গীর শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে হাউস বিল্ডিং থেকে তা’মীরুল মিল্লাত ক্যাম্পাসের দিকে রওনা হয়। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ সাকিল পারবেজ। এক পর্যায়ে টঙ্গী স্টেশন রোড পর্যন্ত আসলে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ হামলা চালায় মিছিলে। অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হয়।

১৮ জুলাই, সকাল ১০টা থেকে উত্তরা বিএনএস সেন্টারে জমায়েত হতে লাগলো হাজার হাজার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের সাথে যোগদান করেন তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা টঙ্গীর হাজার হাজার শিক্ষার্থী। পুলিশের চোখে চোখ রেখে তারা দাঁড়িয়ে ছিল রাজপথে।

প্রথমে এলো টিয়ারসেল। তারপর এলো সাউন্ড গ্রেনেড। এরপর ছররা গুলি। কিন্তু কিছুই থামাতে পারেনি এই ছাত্রদের দৃঢ়তা। বরং শুরু হয়ে যায় এক অঘোষিত যুদ্ধ। দুপুরের পর যখন জনতা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে তখন পুলিশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে! একটা সময় শুধু কান্নার শব্দ, আর্তচিৎকার আর গুলির শব্দে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠেছিল। পরক্ষণে তা’মীরুল মিল্লাতের সাবেক শিক্ষার্থী শাকিল পারভেজ রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন। তাঁর বুকে গুলি লেগেছে। সহপাঠীরা তাকে তাড়াহুড়ো করে স্থায়ী একটি হসপাতালে নিলে সেখান থেকে বাংলাদেশ মেডিকেলে রেফার করে। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে শাহাদাৎ বরণ করেন।

আরেক পাশে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদুল ইসলামের শরীরে ২০০টির বেশি ছররা গুলি বিদ্ধ হলো। সহপাঠীরা তাকে তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে নিয়ে যায়।এখনো তিনি ২শর বেশি ছররা বুলেট শরীরে নিয়ে যন্ত্রণাকারত জীবন পার করছেন।

মুহাম্মদ হাসিবের বুকে গুলি ঢুকে পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি মাটিতে লুটে পড়েন। সাথে সাথে সহযোদ্ধারা হসপাতালে নিয়ে যান। তিনি এখনো পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি।

মুহাম্মদ জুবায়ের আব্দুল্লাহর মাথায় ঢুকে অসংখ্য ছররা গুলি। এখনো ৯টি ছররা গুলি তার শরীরে আছে। এরকম শত শত শিক্ষার্থী আহত হন সেই অঘোষিত যুদ্ধে।

শহীদ শাকিল পারভেজ, শহীদ নাসির ইসলাম ও শহীদ ওসমান পাটোয়ারী (বাঁ থেকে)

শহীদ শাকিল পারভেজের রক্তের প্রতিশোধ নিতে এবার শিক্ষার্থীরা নেমে পড়ল আরও কঠোরভাবে। ২০ জুলাই তা’মীরুল মিল্লাতের হাজারো শিক্ষার্থী, শ্রমিক জনতা মিলে টঙ্গী পশ্চিম থানা ঘেরাও করল। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নেমে এলো হাজার হাজার মানুষ। রাস্তা অবরোধ বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা। সরকার তখন হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়!

রাস্তায় গুলি ছিটকে পড়ছিল, তাতেও ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে সন্ধ্যা নামার পূর্বে চারদিক থেকে যৌথভাবে গুলি করা শুরু করে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। তাদের আক্রমণে এশিয়া পাম্পের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাথে সাথে শহীদ হলেন তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা টঙ্গী’র একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাসির। আহত হন অসংখ্য শিক্ষার্থী। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে হাসপাতালের বেডে আহতরা, কেউ বা রক্তাক্ত শরীর নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে কোথাও। তা’মীরুল মিল্লাত ট্রাস্ট এবং বালাদিল আমিন এলাকা পুরো নিস্তব্ধ।

পরবর্তীতে পুলিশ কতৃক অন্যায়ভাবে তা’মীরুল মিল্লাতের পকেট গেট দেয়াল তৈরি করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে! যেন চিরতরে মাদ্রাসাটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তারা। একপর্যায়ে মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে গ্রেপ্তার করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। তাতেও তারা ক্ষান্ত হননি। তা’মীরুল মিল্লাত কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের নেতৃবৃন্দ এবং অসংখ্য শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দেয়া হয় মামলা। ইচ্ছে মতো ধরে নেওয়া হয় তা’মীরুল মিল্লাত ট্রাস্ট এবং বালাদিল আমিন এলাকার মানুষদের।

যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয় তখন শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ জায়গা থেকে নিকটস্থ স্পটে ৩৬ জুলাইয়ের পূর্ব সময় পর্যন্ত আন্দোলনে যোগ দান করেন। জুলাই বিপ্লব সফল হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

যে ছাত্ররা একসময় কেবল বৈষম্য দেশ চেয়েছিল তারা শেষ পর্যন্ত একটি স্বৈরাচারী সরকারকেই উৎখাত করে দিয়েছে! স্বাক্ষী হয়ে থাকবে রক্তাক্ত দিনগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সফলতার পাতায়।

শত শত শহীদের মধ্যে তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা টঙ্গী ক্যাম্পাস হারিয়েছে তিনটি তাজা প্রাণ। শহীদ শাকিল পারভেজ, শহীদ নাসির,শহীদ ওসমান পাটোয়ারী—তারা কেবল নাম নয়, তারা তা’মীরুল মিল্লাত টঙ্গীর ইতিহাসের পাতায় রক্ত দিয়ে লেখা এক অধ্যায়।

শাকিল পারভেজ ছিলেন পরিবারে একমাত্র ছেলে। গাজীপুর মহানগর শিবিরের দায়িত্বশীল এই তরুণ আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন ১৮ জুলাই। উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে স্লোগান দেওয়ার সময় পুলিশের গুলি শহীদ হন তিনি। প্যারালাইজড মায়ের সেবা করা, বাবার পাশে দাঁড়ানো এই তরুণটি অকালে ঝরে গেলেন।

২০ জুলাই, তা’মীরুল মিল্লাত মাদ্রাসার সামনে আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নাসির ইসলাম। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ছিলেন তিনি। তা’মীরুল মিল্লাত মাদ্রাসার একটি গেট শহীদ নাসির ইসলামের নামে নামকরণ করা হয়।

৪ আগস্ট, ‘ফতহে গণভবন’র আগের দিন শহীদ হন ওসমান পাটোয়ারী। আগের দিন ৩ আগস্ট মাকে বলেছিলেন, ‘মা,পিঠা খাবো।’ কিন্তু সেই পিঠা আর তার ভাগ্যে জুটলো না। আন্দোলনে যাওয়ার আগে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে শেষ কথা বলে অজু-গোসল করে বেরিয়ে যান। শেষ মুহূর্তে মাকে বলেন, ‘আমি শহীদ হলে আমাকে গোসল দিও না। কারণ শহীদদের গোসল দেওয়া হয় না।’ আন্দোলনের ময়দানে গুলিবিদ্ধ হয়ে ফিরে আসেন শহীদ হয়ে।

এসআই/

spot_img
spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- বিজ্ঞাপন -spot_img

সর্বশেষ প্রকাশিত

spot_img