আনিসুর রহমান, ইবি: যে বয়সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে পরিবারের হাল ধরতে পথ হারিয়ে কায়িক পরিশ্রমের কাজে বাধ্য হচ্ছে শিশুরা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ক্যাম্পাসের ভিতরে দেখা যায় এমন দৃশ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ডাইনিং ও দোকান গুলোতে ১০ জনের অধিক শিশু কাজ করছেন। তাদের মধ্যে এমনই একজন হলেন তানজিম হাসান। তার গল্পটা অন্য আর আটদশটা শিশুর মতো না। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই সংসারের বোঝা কাঁধে নিতে হয়েছে তাকে। যে বয়সে তার সহপাঠীদের সাথে স্কুল যাওয়ার কথা, হাতে থাকার কথা ক্লাসের বই, মাঠে ঘাটে ঘুরে বেরানোর কথা বন্ধুদের সঙ্গে, মেতে ওঠার কথা খেলার মাঠ- সেই বয়সে তাকে কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে পরিবারের দায়িত্ব।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পরিবারের রুটি রুজির জোগাড়ের জন্য তাকে আসতে হয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে সে ক্যাম্পাসের লালন শাহ হলের ডাইনিংয়ের খাবার পরিবেশনের কাজ করে সামান্য অর্থ উপার্জন করছে। যেখানে অন্যরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসে উচ্চশিক্ষার কাজে আর সেখানে সে এসেছে পড়াশোনা বাদ দিয়ে হলের ডাইনিংয়ে থালা, বাসন পরিষ্কার ও খাবার পরিবেশনের কাজে।
তানজিম জানায়, দুই ভাই ও এক বোনের মাঝে সে দ্বিতীয়। পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম ব্যক্তি হলো তার বাবা। অন্যের ভ্যান ভাড়ায় চালিয়ে চলে মূলত তাদের সংসার। তবে সেই সামান্য টাকায় নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা তাদের। বাবার ইনকামের টাকায় খাওয়া যেখানে দায় সেখানে পড়াশোনা স্বপ্নের মত। তানজিমের ইচ্ছে ছিল সে বড় হয়ে পড়াশোনা করে বড় ব্যবসায়ী হবে। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব নিতে তাকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
পারিবারিক আর্থিক দুর্দশার কথা চিন্তা করে বাবা মার কাছে ফিরতে চায় না সে। কারণ সেখানে তিনবেলা খাওয়ায় তার কষ্ট হয়।
শুধু তানজিমই নয়, তার মত ১০-১২ জন শিশু-কিশোররা কাজ করছেন ক্যাম্পাসের হল ডাইনিংগুলোতে। তাদের সঙ্গে কথা হলে জানান, স্বপ্ন ছিলো পড়াশোনা করে ভালো কিছু করবে। হাল ধরবে পরিবারের। কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় নেই৷ সব স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে আসতে হয়েছে কাজে। তাদের স্বপ্ন গুলো যেন হাওয়ায় ভাসছে সাদা তুলোর মতো।
বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুসারে, অনুর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে বিবেচিত। আর তাদের দিয়ে কাজ করানো কিংবা কাজে বাধ্য করানো অপরাধের শামিল, রয়েছে শাস্তির বিধান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আল হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আল ইনসান বলেন, ‘শিশুশ্রম সমাজের ব্যাধি। এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুশ্রম করানো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কলঙ্ক। হলের ডাইনিং ম্যানেজারের যথেষ্ট অসেচতনতা রয়েছে। আর তাদের পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত দ্রুততম সময়ে এসবের পদক্ষেপ নেয়া।
এই বিষয়ে লালান শাহ হলের ডাইনিং ম্যানেজার সাবু মিয়া জানান, আমাদের ডাইনিংয়ে অল্প সংখ্যক কর্মী রয়েছে যাদের বয়স ১৮ এর নিচে। তাদের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করেই তাদের এখানে কাজের জন্য নেয়া হয়েছে। আমার বাড়ির পাশে ২ জন এখানে কাজ করে। দেখা যাচ্ছে তাদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়।
যারা পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক তাদেরকে হল বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার জন্য দ্বায়িত্ব নেয়া হয়েছে কিনা প্রশ্নের জবাবে সাবু মিয়া বলেন, না এখনো এধরনের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে কেউ পড়াশোনা করতে চাইলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তাদেরকে যদি আর্থিক সার্পোট দেওয়া হয় তাহলে কাজের পাশাপাশি তারা পড়াশোনা করতে পারে।
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশুশ্রমের বিষয়টি আগে জানা ছিলো না। তবে শিশুশ্রম হয়ে থাকলে এটা ভালো দিক নয়। শিশুশ্রম আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশুশ্রম হোক সেটা কখনোই কাম্য নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদেরকে পড়াশোনার দ্বায়িত্ব নেয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা রয়েছে কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে একটি স্কুল আছে সেক্ষেত্রে তারা বা তাদের পরিবার যদি চায় তাহলে এখানে পড়াশোনা করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এসআই/
মন্তব্য করুন