আব্দুল্লাহ আল বাকী: ‘সদকাতুল ফিতর’ দুটি আরবি শব্দ। সদকা মানে দান, আর ফিতর মানে রোজার সমাপন বা ঈদুল ফিতর। অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করা সদকাকেই সদকাতুল ফিতর বলা হয়। এটিকে ইসলামী পরিভাষায় জাকাতুল ফিতরও বলা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে ফিতরা নামেই বেশি পরিচিত।
সদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব:
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের ওপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর হিসাবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা‘ পরিমাণ আদায় করা ফরয করেছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাত বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।” সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫০৩
সদকাতুল ফিতর কার ওপর ওয়াজিব?
ঈদের দিন সুবহে সাদেকের সময় যার কাছে যাকাত ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ অর্থাৎ অত্যাবশ্যকীয় আসবাব সামগ্রী ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, বাসগৃহ ইত্যাদি বাদ দিয়ে সাড়ে ৫২ তোলা রূপা (বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ মূল্য ৯০০১৬ টাকা) বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সমমূল্য পরিমান সম্পদ থাকে, তাহলে তার উপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব।
ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় এ পরিমাণ মালের মালিক থাকলে, তার উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে। যে শিশু-সন্তানটি ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের পূর্বে ভূমিষ্ট হবে, তার ফিতরাও আদায় করতে হবে।
অর্থাৎ পরিবারের যতজন সদস্য ততটি ফিতরা হিসেবে সকলের ফিতরা আদায় করতে হবে।
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপ্রাপ্ত বয়স্ক, প্রাপ্ত বয়স্ক, আযাদ ও গোলাম প্রত্যেকের পক্ষ থেকে এক সা‘ যব অথবা এক সা‘ খেজুর সদকাতুল ফিতর হিসাবে আদায় করা ফরয করে দিয়েছেন।” সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫১২
সদকাতুল ফিতর কারা পাবে?
যাকাত যারা পাবে, ফিতরারও হক্বদার তারাই হবে। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘নিশ্চয়ই ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৬০)।
উপরিউক্ত ৮টি খাত ছাড়া মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, এতিমখানাও জাকাতের টাকা ব্যায় করা যাবে না। কারণ যাদের জন্য মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল ও এতিমখানা করা হবে, তারা কখনো এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা পান না।
সদকাতুল ফিতর কখন আদায় করতে হবে?
‘আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদেরকে ঈদের সালাতের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দেন।” সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫০৯
ঈদের দিন নামাজের পূর্বে ফিতরা আদায় করায় উত্তম । এছাড়াও কেউ রমজানে ফিতরা প্রদান করলেও হয়ে যাবে ।
কী দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে?
মানুষের সাধারণ খাবার জাতীয় বস্ত্ত দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করা যায়। যেমন, খেজুর, গম, চাল, পনির, ঘি ইত্যাদি।
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ
ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন। এর পরিমাণ হলো, এক সা যব বা এক সা খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটা আবশ্যক। (বোখারি : ১৫১২)।
আবু সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমরা সদকাতুল ফিতর বাবদ এক সা‘ খাদ্য গম অথবা এক সা‘ যব অথবা এক সা‘ খেজুর অথবা এক সা‘ পনির কিংবা এক ‘সা কিসমিস প্রদান করতাম।
ইবনে আব্বাস (রা.) একবার রমজানের শেষ দিকে বসরায় খুতবা প্রদান করেন। সেখানে তিনি বলেন, তোমাদের রোজার সদকা আদায় করো। লোকেরা যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি। তখন ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, এখানে মদিনার কে আছে দাঁড়াও। তোমাদের ভাইদেরকে বলো, তারা তো জানে না। বলো যে, রাসূল (সা.) এই সদকা আবশ্যক করেছেন। এক সা খেজুর বা যব অথবা আধা সা গম প্রত্যেক স্বাধীন-দাস, পুরুষ-নারী, ছোট-বড় সবার ওপর ওয়াজিব। (আবু দাউদ: ১৬২২)
২০২৪ সালের সদকাতুল ফিতরের নির্ধারিত পরিমাণ
ইসলামী ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ’ এর অনুকরণে নিম্নে এবছরের (১৪৪৫ হিজরী/২০২৪ইং) এর সদকাতুল ফিতরের বাজার মূল্য তুলে ধরা হলো:
১. উন্নতমানের আটা বা গমের ক্ষেত্রে ফিতরা এক কেজি ৬৫০ গ্রাম (অর্ধ সা’) বা এর বাজার মূল্য ১১৫ টাকা।
২. যবের ক্ষেত্রে (এক সা’) ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ৪০০ টাকা ফিতরা দিতে হবে।
৩. খেজুরের ক্ষেত্রে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য দুই হাজার ৪৭৫ টাকা
৪. কিসমিসের ক্ষেত্রে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম কিসমিস বা এর বাজার মূল্য দুই হাজার ১৪৫ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করা যাবে।
৫. পনিরের ক্ষেত্রে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২ হাজার ৯৭০ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে।
ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা অদ্ভুত মানসিকতার পরিচয় দেই। আমাদের দেশে সাধারণত সর্বনিম্ন পরিমাণ অর্ধ সা‘ গম এর মূল্য হিসেবে জনপ্রতি ১০০ টাকা হিসেবে সবাই আদায় করতে চান।
কোটিপতি হতে মধ্যবর্তী সবাই সর্বনিম্ন টাকা দিয়েই দায়মুক্ত হতে চান। সবচেয়ে কম মূল্যের গমের হিসাবে সবাই সাদকা করার প্রবণতা খুব বেশি। বিষয়টি রাসূল (সা.)-এর শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
বরং এটা তো সর্বনিম্ন সম্পদের মালিকের জন্য চলে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে তাওফিক দিয়েছেন, তাদের অন্যান্য দ্রব্য দিয়ে সর্বোচ্চ সদকায়ে ফিতর আদায় করা উচিত। কেননা,আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, তোমরা কখনও পুর্ণ অর্জন করতে পারবে না যতক্ষণ না (আল্লাহর পথে) আপন প্রিয়বস্তু হতে ব্যয় করবে। এবং তোমরা যে বস্তু ব্যয় করো নিশ্চয়ই আল্লাহর তা জানা আছে। (সূরা আলে ইমরান,আয়াত-৯২)
তাই সামর্থ্যানুযায়ী বেশি মূল্যের পণ্য দিয়ে ফিতরা আদায়ের চেষ্টা করতে হবে।
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে যথাযথ সদকায়ে ফিতর আদায়ের তাওফিক দান করুন।
লেখক: আব্দুল্লাহ আল বাকী
এমটিআইএস, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
এসআই/
মন্তব্য করুন