নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা দুর্নীতি আর অনিয়মের মাধ্যমে বহুবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)। সম্প্রতি এই দুর্নীতি আর অনিয়ম বেড়েছে বহুগুন, লাগাম টানতে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরে কাটেনি শিক্ষক, ক্লাসরুম, আবাসন সংকট, হচ্ছে না পর্যাপ্ত গবেষণা। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য নেই পর্যাপ্ত বাস। নেই স্থায়ী শহীদ মিনার, অডিটোরিয়াম, টিএসসি এর মত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। তবে প্রতি বছর অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যায় বাবদ খরচ হচ্ছে কোটি টাকা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেট পরিক্ষাকালীন দলের পর্যবেক্ষনে উঠে আসে ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ১৩টি খাতে অনিয়ম ও ক্ষতি করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি খাতের ক্ষতির পরিমাণ টাকায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এতে ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদেরও মোবাইল ভাতা দেওয়া হয়। এভাবে বছরে ১৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা মোবাইল ভাতা দিয়ে সরকারী নিয়মের ব্যত্যয় ও রাজস্বের ক্ষতি করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, মোবাইল ভাতা হিসেবে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদের মাসে এক হাজার টাকা করে, সহকারী অধ্যাপকদের ৬০০ টাকা এবং প্রভাষক ও শাখা কর্মকর্তাদের ৩০০ টাকা করে মোবাইল ভাতা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নির্ধারিত গ্রেডের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মোবাইল ভাতা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও নবম থেকে ষষ্ঠ গ্রেডের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মোবাইল ভাতা দেওয়ার নিয়ম নেই, কিন্তু তা দিয়ে রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় থাকার জন্য সরকার নির্ধারিত হারে টাকা কাটার কথা। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্গফুট হিসাবে বাড়িভাড়া কাটা হয়। এর মাধ্যমে রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে; যার বার্ষিক পরিমাণ ৭৫ লাখ টাকার বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাসা ছোট হওয়ার অজুহাতে এখানে বর্গফুট হিসাব করে বাড়িভাড়া কাটা হয়। অথচ এলাকাভেদে সরকারি বাড়িভাড়ার জন্য নির্ধারিত হরে টাকা দিতে হয়। উচ্চ গ্রেডধারীদের এসব বাসা বরাদ্দ না দিয়ে তা যাঁদের প্রাপ্যতা আছে, তাঁদের বরাদ্দ দেওয়া এবং নিয়ম অনুযায়ী বাসাভাড়ার সম্পূর্ণ অংশ কাটার পরামর্শ দিয়েছে ইউজিসি।
ইউজিসির বাজেট পরীক্ষক দল গত ২৯-৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়টির বাজেট পরীক্ষাকালে বিভিন্ন রকমের অনিয়মের চিত্র পেয়েছে। তারপর সম্প্রতি এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছে ইউজিসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মজিব উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এ-সংক্রান্ত কাগজ আমার কাছে নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদোন্নতি ও আপগ্রেডেশন কার্যকরের সময় বিধিবহির্ভূতভাবে ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে ইউজিসির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে। এতে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় পৌনে সাত লাখ টাকা।
এ বিষয়ে ইউজিসি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদোন্নতি ও আপগ্রেডেশন কার্যকর করার সময় একটি ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই ইতিপূর্বে দেওয়া অতিরিক্ত টাকা সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দিতে বলেছে ইউজিসি।
ইউজিসি বলছে, শিক্ষাসফরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকদের-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত যানবাহনের মাধ্যমে শিক্ষাসফরে পাঠানো হয়। তাদের শিক্ষাসফরকালীন দৈনিক ব্যয় থোক বরাদ্দের মাধ্যমে নির্বাহ করা হয়। তাই আলাদা করে টিএ-ডিএ (ভ্রমণভাতা ও দৈনিক ভাতা) দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাসফরে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের থোক হিসেবে টাকা দেওয়া হলেও শিক্ষকদের আবারও টিএ-ডিএ দেওয়া হয়। এখানে টিএ-ডিএ খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে ইউজিসি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের একাডেমিক বা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা করে দিয়ে রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে বলে ইউজিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যার পরিমাণ ৯ লাখ ৮৭ হাজার। উল্লেখ্য, নিয়মানুযায়ী দায়িত্ব ভাতা মাসে দেড় হাজার টাকা করে নেওয়ার কথা।
ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো গেস্টহাউস না করে রংপুর ও ঢাকায় দুটি গেস্টহাউস ভাড়া নেওয়ার মাধ্যমে নিয়মের ব্যত্যয় ও আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে।
জনবলকাঠামোর বাইরের কোনো পদে পদোন্নতি (পদোন্নয়ন) দেওয়া যায় না, কিন্তু ইউজিসির বাজেট দল দেখতে পেয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ হিসাবরক্ষক, জ্যেষ্ঠ ক্যাটালগার, জ্যেষ্ঠ কম্পিউটার অপারেটর, জ্যেষ্ঠ ভান্ডাররক্ষক, উপাচার্যের জ্যেষ্ঠ একান্ত সহকারী-২ ছাড়াও বেশ কিছু পদ জনবলকাঠামোভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা নিয়মের ব্যত্যয়। এ জন্য জনবলকাঠামো অনুযায়ী কর্মরত পদের সংশ্লিষ্ট উচ্চতর পদে পদোন্নয়ন নীতিমালা সংশোধন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরামর্শ দিয়েছে ইউজিসি।
জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ইউজিসির পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নিলে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এসআই/
মন্তব্য করুন