এডুকেশন টাইমস ডেস্ক: একজন শিক্ষার্থীর জীবনে নতুন এক অধ্যায় শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। জীবনের নতুন যাত্রাকাল থেকেই ভবিষ্যতের জন্য নতুন করে প্রস্তুতিও দরকার হয়। সেই প্রস্তুতির লক্ষ্যেই এ সময়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কিছু মৌলিক দক্ষতা অর্জন করা অতীব জরুরি। এ দক্ষতা শুধু পড়াশোনায় নয়, পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত কিংবা কর্মজীবনেও কাজে লাগে। ভবিষ্যৎ জীবনে উন্নয়নের জন্যই এসব প্রস্তুতি নিতে হয়। এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার কথা থাকছে এই লেখায়:
সময় ব্যবস্থাপনা
সময়ের সঠিক ব্যবহার ও উপযুক্ত সময়ে সঠিক কাজটি করে ফেলা জীবনের সফল হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে জীবনে সফল হওয়ার অন্যতম চাবিকাঠিও এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় ব্যবস্থাপনা একটি অপরিহার্য দক্ষতা। ক্লাস, পড়াশোনা, ব্যক্তিগত কাজ ও সামাজিক কর্মকাণ্ড- এই সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে যেকোনো শিক্ষার্থীর পক্ষে সফল হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। পরিকল্পিত সময় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাঁদের পড়াশোনা এবং অন্য কার্যক্রমে সুষ্ঠু সমন্বয় করতে পারেন। সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং প্রতিটি কাজে সঠিক সময় বরাদ্দ করা সফলতার পথে প্রথম পদক্ষেপ।
স্ব-উদ্দীপনা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতিতে অনেকটা স্বাধীনতা থাকে। তাই শিক্ষার্থীদের স্ব-উদ্দীপনা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। শিক্ষকেরা শুধু নির্দেশনা দেবেন, কিন্তু পড়াশোনার মূল দায়িত্ব শিক্ষার্থীর ওপরই বর্তায়। নিয়মিত পড়ালেখা, ক্লাসে মনোযোগী হওয়া এবং নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা একান্ত প্রয়োজনীয়।
গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের দক্ষতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মূল্য লক্ষ্য হচ্ছে, পূর্বে জ্ঞানকে প্রশ্ন করা এবং সেই প্রশ্নের উত্তরে নতুন কিছুর সন্ধা ও তা বের করে আনা। এই কাজটিকেই আমরা গবেষণা বলে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সাথে গবেষণা জড়িত। গবেষণা বিহীন উচ্চশিক্ষার পূর্ণতা অসম্ভব। তাই স্নাতক প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থীদের গবেষণাকাজের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের বই, জার্নাল, অনলাইন ডেটাবেইস থেকে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের দক্ষতা তৈরি করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার সঠিকভাবে জানতে পারা একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। এই দক্ষতে একজন শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের নিজের যোগ্যতার প্রমাণ করতে উপযুক্ত করে গড়ে তুলবে।
ভাষা শিক্ষা:
দার্শনিক বার্টান্ড রাসেলের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের ভাষা শিক্ষা দেওয়া। এর সাথে তিনি আরেকটি বিষয় যুক্ত করেছেন সেটা হচ্ছে, গণিত শিক্ষা দেওয়া। রাসেলের মতে গণিত হচ্ছে বিজ্ঞানের ভাষা। তথা তার মতে ভাষা শিক্ষা দেওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হওয়া উচিত। ভাষাগত উচ্চতর দক্ষতা একজন মানুষকে জ্ঞানের দিক থেকে ও যোগাযোগে সমৃদ্ধ করে তুলে। বর্তমানে ইংরেজি ভাষা বিশ্বের যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। গবেষণা, উচ্চশিক্ষা, বিশ্ববাজার থেকে দেশের বাজারে চাকরির ক্ষেত্রের ইংরেজি ভাষার দক্ষতা একজন শিক্ষার্থীকে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রাখে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই একজন শিক্ষার্থীর উচিত মাতৃভাষা বাদে দুয়েকটি ভাষা শিখে ফেলা।
যোগাযোগ দক্ষতা
শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনে সফল হতে হলে একজন শিক্ষার্থীর জন্য যোগাযোগ দক্ষতা অপরিহার্য। মৌখিক ও লিখিত—উভয় ধরনের যোগাযোগে সাবলীল হওয়া প্রয়োজন। শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করা, গ্রুপ প্রেজেন্টেশনে অংশগ্রহণ করা এবং সহপাঠীদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক আচরণ করা এই দক্ষতার বিকাশে সাহায্য করে।
সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও সমস্যা সমাধান
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শুধু তথ্য শেখানো হয় না, বরং সেই তথ্যের বিশ্লেষণ এবং সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। এটি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে এবং নতুন আইডিয়া বা মতামত গঠনে সাহায্য করে। প্রথম বর্ষ থেকে সমালোচনামূলক চিন্তা করার ক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে।
নেটওয়ার্কিং ও সম্পর্ক গঠন
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়। এখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অন্য পেশাজীবীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একজন শিক্ষার্থী যদি প্রথম থেকে নেটওয়ার্কিংয়ের গুরুত্ব বোঝে এবং সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাগত ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে, তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে।
প্রযুক্তিগত দক্ষতা
বর্তমানে প্রযুক্তির দক্ষতা থাকা অপরিহার্য। বিভিন্ন সফটওয়্যার ও টুল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা তাঁদের একাডেমিক ও ব্যক্তিগত জীবনের কাজগুলো সহজে সম্পন্ন করতে পারেন। প্রথম বর্ষ থেকে বিভিন্ন ডিজিটাল টুল; যেমন ওয়ার্ড প্রসেসর, স্প্রেডশিট, প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যার, প্রোগ্রামিং এবং অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার শেখা উচিত।
প্রেজেন্টেশন দক্ষতা
নিজেকে আত্মবিশ্বাসের সাথে সঠিক জায়গায় উপযুক্তভাবে উপস্থাপন করতে পারা ব্যক্তির একটি বাড়তি ও বড় যোগ্যতা। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজেকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে না পারার ঘাটতি ব্যাপক আকারে দেখা যায়। বিশেষ করে চাকরির ভাইভা বা ব্যবসার ক্ষেত্রেও নিজের চিন্তা বা পরিকল্পনাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা সফলতার জন্য অপরিহার্য।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নতুন চাপ এবং স্বাধীনতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হতে পারে। তাই আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। এটি একজন শিক্ষার্থীকে নিজের এবং অন্যদের আবেগ বোঝা, নিয়ন্ত্রণ করা এবং বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতিতে ইতিবাচকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।
সমষ্টিগত কাজের দক্ষতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে প্রায়শই দলগত কার্যক্রম বা গ্রুপ প্রজেক্ট থাকে। তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলগত কাজের দক্ষতা থাকা জরুরি। কীভাবে দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হয়, বিভিন্ন মতামত শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করা এবং সহকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করা—এসব বিষয় দক্ষতার অংশ।
লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিকল্পনা
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর থেকে লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা সফলতার মূলমন্ত্র। শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের কী অর্জন করতে চান, কোথায় নিজের শক্তি বা দুর্বলতা রয়েছে—এই বিষয়গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য তৈরি করে তা ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে পূরণের জন্য পরিকল্পনা করলে অগ্রগতি মাপা এবং ফল অর্জন করা সহজ হয়।
স্নাতকের প্রথম বর্ষটি হলো নিজের ভিত তৈরির সময়। এ সময়ে যেসব দক্ষতা তৈরি করা হবে, সেগুলো ভবিষ্যতে শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিকল্পিতভাবে এই দক্ষতাগুলো অর্জন করলে একজন শিক্ষার্থী তাঁর স্নাতকের সময়কে শুধু সফল করতে পারবেন না, বরং পেশাগত জীবনেও এগিয়ে থাকবেন।
এসআই/
মন্তব্য করুন