শাকিল শাহরিয়ার: সাহিত্য চিরকালই সমাজ ও সময়ের প্রতিচ্ছবি। এমনকি কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে ভারত ভাগের প্রকৃত চিত্র ইতিহাসের থেকেও আরও অনেক সুচারু ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ফুটে উঠেছে তৎকালীন শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সৃষ্টিতে।
দেশভাগের সব থেকে বেশি আঁচ পোহাতে হয়েছে বাংলা আর পাঞ্জাবকে। তবে স্বাধীনতা ও দেশভাগের চিত্র ধরা রয়েছে বাংলা ও পাঞ্জাবি ছাড়াও আরও বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে। উর্দু ভাষায় সেই সময়ের দলিল তুলে ধরা লেখকদের মধ্যে সাদাত হাসান মান্টো অন্যতম। স্বাধীনতার সময়ের ঘটনাবলী তাঁর মননে যে যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে, সেই যন্ত্রণাই ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়।
দেশভাগের ঘটনা যেন সমগ্র মানবতাবোধকেই ক্ষতবিক্ষত করেছে। বছরের পর বছর পাশাপাশি থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করেই পরস্পরের শত্রু হয়ে ওঠে। ধর্ম আর দেশভাগ তাদের দীর্ঘকাল লালিত ভদ্রতার আবরণ ছিন্ন করে মানুষের মনের অন্ধকার দিকগুলো প্রকাশ করে দিয়েছে। সেই সব দুর্ভাগা মানুষের কষ্ট আর ক্ষতবিক্ষত মানবতার চেহারা প্রকাশ পেয়েছে মান্টোর লেখা বিভিন্ন ছোটগল্প ও প্রবন্ধের মধ্যে।
কোনোরকম শিষ্টতার আবরণ না রেখে তিনি সরাসরি সেই নিষ্ঠুর ঘটনার ছবি তুলে ধরেছেন তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে। ভীষণ সূক্ষ্ম অথচ প্রবলভাবে বিদ্যমান মানব চরিত্রের বিভিন্ন দিক প্রায় দুদশক ধরে বিভিন্ন লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি তাঁর নিপুণ কলমের আঁচড়ে। কোনো বিচার না করলেও আলাদা আলাদা একেকটা ঘটনার বর্ণনা যেন দেশভাগের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে ধরা পড়েছে তাঁর লেখায়। কখনও কখনও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন আর সাহিত্য এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে যে তাদের আলাদা করাই দুঃসাধ্য হয়ে যায়।
মান্টো তো কেবল একজন গল্প লেখকই নয়, ছিলেন প্রচণ্ড সমাজ সচেতন। তার লেখার ধরন কাল্পনিক নয়। সমস্তই চরম বাস্তবিক। মান্টো যখন নতুন গল্প লেখার কথা ভাবতেন, সারারাত ধরে ভাবতেন কীভাবে শুরু হবে। ভোর পাঁচ টায় ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ নিয়ে বসতেন যদি মিলে গল্পের রসদ। তার প্রতিটি গল্পই চরম সত্য এবং বাস্তবিক। হয়তো কোনো গল্পের প্লট এলো না পত্রিকা থেকে, তখন বাথরুমে চলে যেতেন, ভাবতেন, কীভাবে শুরু করা যায়। হয়তো সেখানেও বৃথা। অতঃপর স্ত্রীর সঙ্গে বিনা কারণে ঝগড়া করে গল্পের প্লট খুঁজতে যাওয়া, সেখানেও না পেলে রাস্তায় নেমে প্রথমে একটি পান কিনে চোখ বোজা তারপর জীবন দেখতে দেখতে গল্প লেখার রসদ খোঁজা।
অবশ্য মান্টোর জীবনে গল্পের রসদের তো অভাব হয়নি। তিনি চাইলে কেবল ফিল্মিস্তানের থাকাকালীন সময়ে, অভিনেতা অভিনেত্রী প্রযোজকদের নিয়ে শয়ে শয়ে গল্প ফাঁদতে পারতেন। কিন্তু সচেতনভাবেই মান্টো তা করেননি। তিনি জীবনকে পূর্ণ বাস্তবতায় তুলে এনেছেন গল্পের ভাষায়। তাইতো টোবা টেক সিং গল্পে দেখা যায় বিষান সিং নামের এক অমুসলিম পাগলের চিত্র। দেশভাগের দুই তিন বছর পরে দুই দেশের সরকার সিদ্ধান্ত নিলো পাগলদেরও ভাগাভাগি হবে। অর্থাৎ হিন্দু পাগলদের ভারত এবং মুসলিম পাগলদের পাকিস্তানে পাঠানো হবে। লাহোরের মানসিক হাসপাতালে থাকা পাগল বিষান সিং বাকি সহবন্দীদের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে কী করে নিজ গ্রামে ফেরা যায়। যেহেতু সে হিন্দু তাই ভারতে চলে যেতে হবে তাকে। কিন্তু বিষান সিং ফিরে যেতে চায় পাকিস্তানে তার প্রিয় গ্রাম টোবা টেক সিং এ।
সাদাত হাসান মান্টোর জন্ম ১৯১২ সালের ১১ মে ভারতের পাঞ্জাবের লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামের এক ব্যারিস্টার পরিবারে। মান্টোর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত। তার বাবা গুলাম হাসান মান্টো ছিলেন আদালতের বিচারক। পারিবারিক ঐতিহ্যের জন্য দারুণ গর্বিত ছিলেন মান্টো। ভাইবোনদের মধ্যে মান্টো ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত বলে দারুণ গর্ব বোধ করতেন তার পরিবার। কাশ্মীরি লোকজনের সাক্ষাৎ পেলে তার বাবা দারুণ সমাদর করতেন। তাঁর পাঠান মা সর্দার বেগম ছিলেন বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। মান্টোদের মতো অভিজাত বংশের মহিলা না হওয়ার দরুন সর্দার বেগম মান্টো তাঁর স্বামীর পরিবার ও আগের পক্ষের সন্তানদের কাছ থেকে মানমর্যাদা ও ভালোবাসা পান নি। মায়ের জীবনের বঞ্চনা ও উপেক্ষা মান্টোকে তাঁর বাবা ও দাদাদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। শৈশবে প্রাপ্ত অবহেলার অভিজ্ঞতা মান্টোর মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। হয়তো সেই কারণেই অনুভূতির বাড়াবাড়ি প্রদর্শনের অভ্যাস তৈরী হয়েছিল তাঁর। একই সঙ্গে তিনি হয়ে উঠেছিলেন গভীর আত্মবিশ্বাসী ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষ।
পেশায় আইনজীবী বাবা চেয়েছিলেন মান্টো যেন ডাক্তার হন। কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর অনাগ্রহের কারণে তিনি স্কুলে বারেবারেই অকৃতকার্য হন। শেষ পর্যন্ত স্কুল আর বিষয় বদলে চতুর্থবারের চেষ্টায় স্কুলের শেষ পরীক্ষায় পাস করলেও ভবিষ্যতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্পলেখক মান্টো বিস্ময়কর ভাবে উর্দু ভাষায় অকৃতকার্য হন। ছেলেকে মান্টো বংশের কুলাঙ্গার জেনেই তাঁর বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্কুলের পরীক্ষায় সফল ছাত্র না হলেও তিনি সাহিত্যের সফল শিক্ষার্থী ছিলেন। গোগ্রাসে তৎকালীন বৈপ্লবিক সাহিত্য পড়তে শুরু করেন। ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব থাকলেও কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের রাজনীতি তাঁর নিতান্তই অপছন্দ ছিল। বরং তিনি স্বপ্ন দেখতেন যে ভগত সিংয়ের মতনই সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি ভারত থেকে ইংরেজদের তাড়াচ্ছেন। ১৯৩৩ সালে তাঁর পরিচয় হয় আব্দুল বারী আলিগের সঙ্গে। আলিগের উৎসাহেই তিনি রাশিয়ান ও ফরাসি সাহিত্যর ইংরেজি অনুবাদকে উর্দু ভাষায় রূপান্তরের কাজ শুরু করেন।
বিভিন্ন সংবাদপত্র, ম্যাগাজিনে লেখালেখি মান্টোকে বম্বে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় প্রবেশাধিকার দেয়। সেখানেও তিনি সফল হয়েছিলেন। মাঝে ১৯৪১ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওর উর্দু সার্ভিসের জন্য লেখার চাকরিতে যোগ দেন। পরবর্তী দেড় বছরে তিনি সম্ভবত সব থেকে বেশি লিখেছেন। পরে বম্বে টকিস-এ যখন তিনি লেখক হিসেবে যোগদান করেন ততদিনে ভারত ভাগ হয়ে গিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ভারতেই থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রাজনৈতিক ডামাডোল, সাম্প্রদায়িকতার নারকীয় প্রকাশ, ধর্মের ভিত্তিতে পেশাগত জটিলতা ইত্যাদি নানা কারণে নতুন জন্ম নেওয়া দুই দেশের কোন দেশে থাকবেন সেই নিয়ে দ্বিধায় পড়েন তিনি।
১৯৪৭ এ স্বাধীনতা ভীষণ উদ্দীপনার সঙ্গে উদযাপিত হয় সারা দেশ জুড়ে। বম্বেতেও মানুষের উচ্ছ্বাস, জাঁকজমক আর আলোর রোশনাই ছিল দেখার মতন। আবার একই সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে দাঙ্গা হাঙ্গামা, লুঠতরাজ, খুনোখুনি, ধর্ষণ কত অজস্র মানুষের জীবনে অন্ধকার এনে দেয়। মান্টোর মনে প্রশ্ন জাগে এত যে রক্ত বইছে প্রতিদিন, সেই রক্ত কার? ভারতীয় নাকি পাকিস্থানি মানুষের? দুই দেশ স্বাধীন তো হলো, কিন্তু এরপর? হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্ব শুরু হয় তাঁর কাজের জায়গা বম্বে টকিস-এও। হঠাৎ করেই এরপর তিনি লাহোরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভীষণ কাছের বন্ধুদেরও বিদায় না জানিয়ে বারো বছরের বম্বের পাট চুকিয়ে তিনি একদিন পাকিস্থান রওনা হলেন। যাওয়ার সময় আর কেউ না, শুধুমাত্র প্রিয় বন্ধু শ্যাম এসেছিলেন তাঁকে বিদায় জানাতে।
পাকিস্থানে গিয়েও তাঁর লেখা অব্যাহত ছিল। সেখানেও তিনি চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত হন। পাকিস্থানে লেখা গল্পগুলোই সম্ভবত তাঁর সব থেকে বিখ্যাত ও বিতর্কিত। তবে মান্টো ততদিনে দেশভাগের যন্ত্রণা ও দেশ ত্যাগের অভিঘাতে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। মদের নেশায় তিনি পুরোপুরি ডুবে গেলেন। ফল হল লিভারের ক্ষত। এই অসুখেই মাত্র ৪৩ বছরে তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৫৫ সালে। তাঁর জীবনের শেষদিনগুলো কেটেছে মানসিক হাসপাতালে।
মান্টোর দেশভাগের গল্পে মানুষের আচার ব্যবহার নিয়ে কোনো কাটাছেঁড়া নজরে পড়ে না। বরং গল্পগুলো এক অদ্ভুত নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘটনার বর্ণনা দেয়। ভীষণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলা গল্পে নেই কোনো পক্ষপাত, নেই কোনো অতিরঞ্জন অথবা অকারণ শালীনতার মোড়ক। সেই আপাত নির্বিকার নিরাসক্ত বর্ণনা পাঠকের অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দেয়। মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলোর এমন বহিঃপ্রকাশ পাঠককে শিউরে উঠতে বাধ্য করে। দোষ কোনও ধর্মের মানুষের নয়, দোষ পরিস্থিতি আর ঘটনাপ্রবাহের, এটাই যেন বলতে চেয়েছেন মান্টো।
স্বাধীনতা আনন্দের সঙ্গে দেশভাগের যন্ত্রণা আমাদের ভারত, পাকিস্থান দুই দেশকেই সহ্য করতে হয়েছে। স্বাধীন দেশের জন্মলগ্ন থেকেই। আজও করে চলেছে। ‘বাটোয়ারা’, এই শব্দটাই দেশভাগ বোঝাতে ব্যবহার করেছেন মান্টো। এই বাটোয়ারা নিয়ে তাঁর ছোটগল্পগুলিতে তৎকালীন বীভৎসতা ফুটে উঠেছে খুব স্পষ্ট ভাবে। সেখানে কোনও রোমান্টিকতা নয়, বরং নিষ্ঠুর বাস্তব তার সমস্ত দাঁত নখ নিয়ে নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
মান্টোর লেখা ‘খুলে দাও’, ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’, দুটি গল্পেই দাঙ্গা, লুঠ আর উদ্বাস্তু সমস্যার সঙ্গে নারী নির্যাতনের গল্প আলাদাভাবে চোখে পড়ে। পাকিস্থানে সাধারণ পাঠকের চোখে অশ্লীল এই গল্প দুটি প্রকাশ করার অপরাধে প্রকাশক ও পত্রিকা দুটিকে মূল্য চোকাতে হয়। ‘খুলে দাও’ গল্পের প্রকাশক পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয় ছয় মাসের জন্য আর ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’ এর প্রকাশক পত্রিকাকে আর্থিক জরিমানায় দণ্ডিত করা হয়।
রাষ্ট্র, ধর্মবাদী থেকে প্রগতিশীল—সবাই একযোগে সাদত হাসান মান্টোকে খারিজ করে দিলেও তিনি গল্পকার হিসেবে নিজের অবস্থান জানতেন। মৃত্যুর এক বছর আগে লেখা নিজের এপিটাফে তিনি বলে গেছেন, ‘এখানে সমাধি তলে শুয়ে আছে মান্টো আর তাঁর বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প বলার সব কৌশল আর রহস্য।’ কখনো ফতোয়া এসেছে, অশ্লীলতার জন্য মামলা হয়েছে ছয়বার, বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মান্টোর চারপাশে বয়ে চলা জীবনের প্রতি আকর্ষণ আর তাঁর কলম কেউ থামাতে পারেনি।
খোল দো গল্প প্রকাশের দায়ে উর্দু মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘নাকুশ’-এর প্রকাশনা ছয় মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলো। তখন এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আহমদ নাদিম কাজমি। আর ‘ঠান্ডা গোস্ত’ প্রকাশের জন্য জরিমানা করা হলো ‘জাবেদ সাময়িকী’কে। ‘আউর দরমিয়ান’-এর ছাপা নিষিদ্ধ করা হলে কোনো পত্রিকাই তার পরবর্তী কিস্তিগুলো ছাপতে রাজি হয়নি। ১৯৫০ সালের আগস্টে তো বিটার ফ্রুট গল্পের জন্যে অশ্লীলতার অভিযোগে তাকে লাহোর আদালতে অভিযুক্ত হয়ে আসতে হলো।
আর্থিক দুরবস্থার কারণে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেননি মান্টো। একটা সময় তরুণ আইনজীবী শেখ খুরশিদ আলম এগিয়ে এলেন। তিনিসহ তিন জন তরুণ উকিল মান্টোর পক্ষে দাঁড়ালেন। সিয়াহ হাশিয়ে বইয়ের ভূমিকা লিখতে হাসান আসকারিকে বললেন। হাসান আসকারিও লিখলেন। তখন আসকারি সদ্য দায়িত্ব পেয়েছিলেন পাকিস্তানের পরিচয় কেমন হবে এমন উপদেষ্টা হিসেবে। কিন্তু হাসান আসকারি ছিলেন লেখক সংঘের বিরুদ্ধে। আহমদ নাদিম কাজমি ও সরদার জাফরি মান্টোকে বললেন হাসান আসকারিকে দিয়ে যেন ভূমিকা না লেখান। কিন্তু কোন জবাব দিলেন না মান্টো। তাই প্রগতিশীল লেখকদের সঙ্গে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হয়ে গেল তার।মান্টো হয়ে পড়লেন বন্ধুহীন। প্রিয় বন্ধু ইসমত চুগতাইকে চিঠিতে লিখেছিলেন তিনি ফিরে যেতে চান বোম্বাইতে। কিন্তু ততোক্ষণে তার ফেরার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। এদিকে ঘরে টাকা নেই। তখন তার একমাত্র বন্ধু মদ।
একদিন মান্টো অধৈর্য হয়ে লিখেছিলেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ‘এক দিন হয়তো পাকিস্তানের সরকার আমার কফিনে একটা মেডেলও পরিয়ে দেবে। সেটাই হবে আমার চরম অপমান।’ মৃত্যুর কিছুদিন আগে কবর জিয়ারত করে ফিরে আসছেন মান্টো ও তার স্ত্রী সাফিয়া। কবরস্থান থেকে বেরুতে বেরুতে একটি পুরাতন কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মান্টো বললেন, ‘এখানে শুয়ে আছেন সাদত হাসান মান্টো। সে জানতো গল্প লেখার সমস্ত কলাকৌশল। কিন্তু মাটির নিচে শুয়ে সে এটাই ভাবছে, সবচেয়ে সেরা গল্প লেখকটি আসলে কে? সে নিজে নাকি খোদা!”
একটা সময় সস্তা বাজে মদপানের জন্য লিভার সিরোসিসের আক্রান্ত হলেন মান্টো। তখনো বেপরোয়া জীবন চলছে তার। সেই ভঙ্গুর শরীরেই একের পর এক গল্প, রাজনৈতিক সমালোচনা লিখেই যাচ্ছেন তিনি। একদিকে অভাব, একদিকে আর্থিক অনটন, একদিকে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য আর প্রচণ্ড মদের নেশা তাকে শারীরিকভাবে নিঃশেষ করে দিলো যেন। লিখেছিলেন মান্টো রাত দিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে সংসারের জন্য। “কিন্তু আমার প্রচণ্ড ভয় হয়। আজ যদি চিরকালের জন্য চোখ বুঁজি তবে আমার স্ত্রী ও তিন কন্যার দেখাশোনার দায়িত্ব কে নেবে?” মৃত্যু তখন নিকটে তার।
মান্টোর ভাগ্নে হামিদ জালাল লিখেছিলেন মান্টোর অন্তিম অবস্থা নিয়ে। হামিদ জালাল লিখেছিলেন, ‘মৃত্যুর প্রাক্কালে নাটকীয়ভাবে মান্টো মামা মদ পানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রক্তবমি হচ্ছে, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। তিনি জানতেন, মদ তার জন্য বিষ। তিনি মৃত্যুকেও সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছেন। হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য সংবাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি বললেন, “কোটের পকেটে সাড়ে তিন টাকা আছে, দুই প্যাক হুইস্কি আনাও।” তার শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য হুইস্কি আনা হলো। এক চামচ হুইস্কি তার মুখে দেওয়া হলো। কয়েক ফোঁটা গলায় ঢুকল আর অবশিষ্টটুকু মুখ থেকে বাইরে গড়িয়ে পড়ল। এর মাঝে সারা দেহে খিঁচুনি শুরু হয়েছে। তখন তিনি অজ্ঞান, অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মান্টো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সেদিন ছিল ১৮ জানুয়ারি, ১৯৫৫ সাল।’
যে সাদত হাসান মান্টোকে বলা হয় উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, সে মান্টো ক্লাসের পরীক্ষায় উর্দুতে কখনো পাশ করতে পারেন নি। যে মান্টোকে বলা হয় উপমহাদেশের সবচেয়ে নির্মম গল্পকার, সে মান্টোর উপর এসেছিলো ভয়ঙ্কর নির্মমতা। যে মান্টো লিখে গেছেন ধর্মান্ধতা, বাস্তবতা, অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে, সেই মান্টোর জীবন অতিষ্ঠ করা হলো একই প্রকারের শাস্তিতে। কিন্তু দমেননি মান্টো।
জীবনটা ছিল তার স্রোতের প্রতিকূলে প্রবাহমান এক নদী। নদী বললে অবশ্য কমই বলা হবে, বলা যায় সমুদ্র। সমুদ্রের চেয়ে অতল যার গভীরতা, প্রকাণ্ড শক্তিমান জীবনবোধ। যিনি দেখিয়েছেন জীবনের আলোকোজ্জ্বল পথেও কতোখানি আঁধার থাকে, কতোখানি পূর্ণতার মাঝে পাওয়া যায় গভীরতম শূন্যতা। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলা যায় ইতিহাস আর বর্তমানের নিষ্ঠুরতম সত্য। নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে দাঁড়ানো যায় কালের সমস্ত ভণ্ডামি আর সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে। সকালের স্নিগ্ধতার চেয়ে রাতের আঁধার গ্রাস করতো তাকে। সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা, বিভীষিকা, তার সাহিত্যের নিষিদ্ধ হওয়া, কোনটিই বাদ যায়নি। তার ওপর আঘাতের পর আঘাত এসেছে। তাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল শাসকেরা। কিন্তু তিনি তো চিরকালের। নিজের মৃত্যুর এক বছর আগে যিনি লিখতে পারেন “এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মান্টো। আর তার বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প লেখার সমস্ত কৌশল।” তাইতো আঁধারের বুকে এক আলোর জীবনশিল্পী সাদত হাসান মান্টো।
লেখা: শাকিল শাহরিয়ার
এডুকেশন টাইমস
মন্তব্য করুন