শাকিল শাহরিয়ার: আহমদ ছফা ছিলেন অদ্ভুত এক চরিত্র। ছফা শব্দটা শুনলেই দাঁত-মুখ খিঁচানো, কপাল ও ভুরু কুঁচকানো, হঠাৎ হঠাৎ মেয়েলি সুরেলা কণ্ঠ এবং কখনো আঞ্চলিকতামিশ্রিত বিশেষ কথ্যভঙ্গির এক লেখকের ছবি মনে আসে। ছফা কখনোই নিজেকে কেবল সাহিত্যের মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের মতামত নির্ভর বুদ্ধিজীবী রূপেও আবদ্ধ করেননি নিজেকে। তিনি তুলে এনেছেন বাস্তবতার কঠিন চিত্র।
গৃহী না হলেও ছফা অন্যদিকে দেশ ও জাতির প্রতি ছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে দায়িত্বশীল, হইচইভরা টগবগে মানুষ, দারুণ বন্ধুবৎসল, রাগে-অনুরাগে উষ্ণ, বেজায় দরদি ও আবেগপ্রবণ; আবার কখনো ক্ষিপ্ত, কখনো মেজাজি দুর্মুখ এবং তীব্র প্রতিবাদী৷
১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। চট্টগ্রামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া সমাপ্ত করে ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এই মহান কবির মৃত্যু হয় ২০০১ সালের ২৮ জুলাই।
আহমদ ছফা ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী একজন সৃষ্টিশীল লেখক। ষাটের দশকে তাঁর সাহিত্য-জীবনের সূচনা হয়। আহমদ ছফা এত বিচিত্র বিষয়ে লিখেছেন, এত বিচিত্র তাঁর পরিচয় যে ছোট একটা লেখায় সেসবের দিকে প্রলুব্ধ করা কঠিন।
আহমদ ছফার রচনা উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা সবখানেই তার সেই শক্তিমান বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের উপস্থিতি দেখা যায়। তবে কেবল সাহিত্যই নয়, তার জীবনধারণ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, দর্শনেও সেই শক্তির দেখা মেলে। বাস্তবতার নিরিখে লেখা কথা সাহিত্য, নির্মোহ সমালোচনা তাকে করে তুলেছে কিংবদন্তি। আহমদ ছফা কেবল কথাসাহিত্যিকই নন, হয়ে উঠেছেন গণমানুষের প্রতিনিধি।
তত্ত্বের গুরুগম্ভীর কচকচানি যদি আপনাকে নিরুৎসাহিত করে, আপনি আহমদ ছফা পড়তে পারেন। ফিকশন ও নন-ফিকশন দুটোই ভালো লিখতেন ছফা। ফলে চারুতার সঙ্গে প্রজ্ঞার চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে ছফার লেখায়। তাঁর লেখা সরল ও সুখপাঠ্য। কিন্তু যেসব জ্ঞানকাণ্ড ও সিদ্ধান্ত অনুমান করে তিনি লিখতেন, সেগুলো বেশির ভাগ সময়ই মৌলিক।
কিছুদিন পরপরই বাঙালি, বাংলাদেশি, বাঙালি মুসলমান ইত্যাদি নিয়ে চক্রাকারে যে বিতর্ক ঘনিয়ে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সেই বিতর্কের প্রথম লেখা আহমদ ছফার ‘বাঙালির মুসলমানের মন’। লেখাটির সঙ্গে আপনি দ্বিমত হতে পারেন, বেশ কিছু পদ্ধতিগত ভুলও প্রমাণ করতে পারবেন, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সামষ্টিক মন বুঝতে ছফার দৃষ্টিভঙ্গিকে মোকাবিলা না করে পারবেন না। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার চেহারা-সুরত বুঝতে ‘বুদ্ধবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এর মতো বই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভয়াবহ সংকীর্ণ ও একমাত্রিক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে ছফা এমন কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন, যেগুলো প্রচলিত বস্তাপচা চিন্তাকাঠামোকে অস্বস্তি দিয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির একটা শক্তিশালী প্রবণতার ধারক ও বাহক ছফা।এই সব সিরিয়াস বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপে আপনি অনাগ্রহী হলে ছফার ফিকশনগুলো পড়েন। বিশেষত শেষের দিকে রচিত উপন্যাসগুলোতে তাঁর রসবোধ অসামান্য।
জিনিস একসঙ্গে না থাকলে ভালো স্যাটায়ার লেখা সম্ভব নয়। আহমদ ছফার দুটোই ছিল। একটি ভালো রচনার সার্থকতার একটি প্রমাণ হলো রচনাটি প্রকাশের অনেক দিন পরও প্রাসঙ্গিক থাকতে পারা। ‘গাভীবৃত্তান্ত’ উপন্যাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নকশা ও চেহারা-সুরত ছফা এঁকেছেন, এখনকার চা-চপ-সমুচাময়তায় তার আশ্চর্য প্রতিফলন দেখে চমকে উঠতে পারেন।
আহমদ ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিপন্থি একজন সংস্কৃতিকর্মী। প্রগতির সংঘশান্তিতে তিনি আস্থাবান ছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাও ছিল প্রচুর। শাসক, সমাজের মোড়ল, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদ কিংবা ক্ষমতাশালী নেতা-উপনেতা বা প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিঃসঙ্কোচে কঠিন সত্য বলতে পারেন—এমন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা আমাদের দেশে বরাবরই কম। এই নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করার মতো সাহসী বুদ্ধিজীবীদের একজন ছিলেন আহমদ ছফা।
আজ বাংলার ও এদেশের মানুষের লেখক ও বুদ্ধিজীবীর জন্মদিনে তার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। শুভ জন্মদিন গণমানুষের লেখক আহমদ ছফা।
এসআই/
মন্তব্য করুন