সঞ্জীব চৌধুরী: অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সেই অবস্থা যেখানে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, মুদ্রামান, ও প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল থাকে এবং বড় ধরনের অস্থিরতার সম্ভাবনা কম থাকে। এটি এমন একটি অবস্থাকে নির্দেশ করে যেখানে অর্থনীতি তার প্রাকৃতিক ভারসাম্যে থাকে এবং ধারাবাহিকভাবে, স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির হার বজায় রেখে উন্নয়ন করতে পারে। অপরদিকে নৈতিকতা হল মানুষের আচরণ, মূল্যবোধ এবং কাজের মানদণ্ড নির্ধারণের একটি আদর্শ ব্যবস্থা, যা সঠিক ও ফুলের পার্থক্যকে চিহ্নিত করে। এটি মূলত সমাজ ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নিয়মাবলি ও মূল্যবোধ, যা মানুষকে দায়বদ্ধ, সৎ, ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। নৈতিকতা এমন একটি গুণ, যা মানুষের জীবনযাত্রায় সততা, সহানুভুতি, দায়বদ্ধতা, এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বাড়ায়। এটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সুষ্ঠু সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়ক এবং একটি সমৃদ্ধ ও সুন্দর সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে নৈতিকতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকা, যা ক্রয়ক্ষমতা বজায় রাখে। এছাড়া, কর্মসংস্থানের স্থিতিশীল হার এবং মুদ্রার মানের সুরক্ষা অর্থনীতিতে আস্থা বৃদ্ধি করে। যখন কোনো অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকে, তখন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হন এবং ভোক্তারা অর্থ ব্যয় করতে নিরাপদ বোধ করেন। অর্থনীতির এই অবস্থা সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতকে সুরক্ষিত রাখে, ব্যবসা-বাণিজোর প্রসার ঘটায় এবং জনগণের কল্যাণ বৃদ্ধি করে।
অর্থনীতিতে নৈতিক (ethical) বিষয়সমূহের অভাব বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
যেমন, ১) ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কল্যাণের ক্ষতি; অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নৈতিকতার অভাব ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উভয় ক্ষেত্রেই কল্যাণের ক্ষতি করতে পারে। বিশেষ করে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সময় শুধু মুনাফাকেন্দ্রিক চিন্তা নৈতিকভার অভাবে সাধারণ জনগণের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। ২) অনুপাতহীন বৈষম্য বৃদ্ধি নৈতিকতা না থাকলে, সম্পদ বিতরণের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক আচরণ দেখা দেয়, যা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যকে বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি, নীতিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এবং অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী সংকট তৈরি হয়, যা সমাজের সামগ্রিক কল্যাণে ক্ষতির কারণ হয়। ৩) স্বচ্ছতার অভাব ও দুর্নীতি নৈতিক মানদণ্ডের অভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার অভাব দেখা দেয় এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। ৪) ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন: ভোক্তাদের প্রতি যথাযথ দায়বদ্ধতা বা নৈতিক মানদণ্ড না থাকলে, তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে। এতে ভোক্তার আস্থা হ্রাস পায় এবং বাজার ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হয়। ৫) নিয়ন্ত্রক নীতিমালার কার্যকারিতা হ্রাস: যদি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নৈতিকতার অভাব থাংক, তবে অর্থনৈতিক নীতিমালার কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং সেটি সমাজের কল্যাণে অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়। ৬) সংস্কৃতিগত অবক্ষয় অর্থনৈতিক কার্মকাণ্ডে নৈতিকতার অভাব সমাজের সংস্কৃতির উপরও প্রভাব ফেলে এবং এটি দীর্ঘমেয়াদে সমাজের মৌলিক মূল্যবোধকে প্রভাবিত করতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বর্তমানে বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। বর্তমান মূল্যস্ফীতি ৯.৯২% (খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০.৪০%) এবং বেকারত্বের হার ৩.৫১%, যা ২.৫৯ মিলিয়নের বেশি যুবককে
বেকার করে রেখেছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত Transparency International-এর দুর্নীতি সূচক (CPI) অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২৪ স্কোর নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে, শুধুমাত্র আফগানিস্তানই এর নিচে রয়েছে (২০ স্কোর)। এই স্কোর গত বছরের তুলনায় ১ পয়েন্ট কমে যাওয়ায়, দেশের পাবলিক সেক্টরের দুর্নীতি পরিস্থিতির অবনতি প্রতিফলিত হয়। এছাড়া, ২০২২ সালে বাংলাদেশের জিনী কোফিসিয়েন্ট ছিল ০.৪৯৯, যা আয়-বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে।
এই সব সূচকগুলো বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতি একটি চিত্র প্রদান করে। তবে, এর পেছনে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে একদিকে তুলে ধরলেও, দেশের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলো যথাযথভাবে আলোচনা করা হয় না। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও যৌক্তিকতার অভাব। এ কারণে, অনেক অর্থনৈতিক নীতি ও উদ্যোগ যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না এবং সমাজে কাঙ্খিত ফলাফল আসছে না। নৈতিকতা কেবল ব্যক্তি বা ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং একটি বৃহত্তর সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। নৈতিকতা উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, আইনগত প্রয়োগ, ধর্মীয় শিক্ষা, গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং পারিবারিক মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব উপায় সমাজে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সঞ্জীব চৌধুরী গবেষণা কর্মকর্তা (অর্থনীতি)
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা
এসএস/
মন্তব্য করুন