আনিসুর রহমান, ইবি: কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত উক্তি ‘যদি থাকে বন্ধুর মন, গাং পার হইতে কতক্ষণ’। ভালো বন্ধুরা সব সময় একে অপরকে জীবনের সফলতার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সাহায্য করে। সফল ক্যারিয়ার গড়ার পিছনে অন্য সবার থেকে ভালো বন্ধুর অবদানও কম নয়। এমনই তিন সফল বন্ধুর দেখা মিলেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি)। তিন বন্ধুর বাড়ি তিন জেলা হলেও তাদের বিদ্যাপীঠ ছিল একই। তিনজনেরই স্বপ্ন ছিল একই রকম, বিদেশে গিয়ে উচ্চিশিক্ষা গ্রহণের। একই সঙ্গে করতেন পড়াশোনা। অবশেষে আমেরিকার তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বন্ধু ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপে মনোনীত হন।
বলছি বিশ্ববিদ্যালয়টির ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের তিন বন্ধু মামুনুর রশীদ, সুমন আলী ও নাঈম হোসেনের কথা। তারা ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
জানা যায়, কাকতালীয়ভাবে তাদের তিনজনের স্নাতকের রেজাল্ট একই। প্রথম দিকে সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। স্বপ্ন পূরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি স্বরুপ রির্সাচ করা শুরু করেন তারা। প্রথমদিকে রির্সাচের কাজ করার জন্য লালন শাহ হলের কমন রুমকে বেছে নিয়েছিলেন। তারপর করোনা মহামারির সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটস্থ এক বাসায় রুম ভাড়া নিয়ে কাজ চালিয়ে যান তারা।
তাদের ভাষায়, আমরা যখন রির্সাচের মৌলিক কাজ শিখে গেলাম, তারপর আমাদের আর একসাথে থাকা লাগেনি।
সফলতার গল্প জানতে চাইলে তারা বলেন, আমাদের রির্সাচগুলো বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ করতে থাকি। রির্সাচের পাশাপাশি আমরা আইইএলটিএস ও জিআরইয়ের প্রস্তুতিও নিতে থাকি। আইইএলটিএস,জিআরই ও পাবলিকেশন থাকায় আমাদের ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেতে সহজ হয়। তবে আমাদের যাত্রাটা অতোটা সহজ ছিল না।
তারা বলেন, আমাদের এই সফলতার পিছনে আমাদের সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. বখতিয়ার হাসান স্যারের অবদান সব চেয়ে বেশি। বখতিয়ার হাসান স্যার আমাদেরকে হাতে-কলমে গবেষণা শিখিয়েছেন, আমি হলফ করে বলতে পারি, বাংলাদেশে এরকম সুপারভাইজার হাতেগোনা কিছু পাওয়া যাবে। বিশেষত ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে। উনি সব সময় আমাদেরকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। দেশি এবং আন্তর্জাতিক মানের গবেষকদের সাথে গবেষণা করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন।
নাঈম হোসেন বলেন, ‘মানুষের ভিন্নভিন্ন লক্ষ থাকে। বিসিএস অবশ্যই ভালো জব বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে। তবে, আমি কখনো সাধারণ জ্ঞান বা অনেক মুখস্থ পড়ায় আগ্রহ পেতাম না। অন্যদের মত আমার পরিবার থেকেও বিসিএসকে গুরুত্ব দিতেন। এমনকি যখন আমি গবেষণার জন্য লক্ষ্য ঠিক করি, আমার পরিবার প্রথমে নারাজ থাকলেও এখন তারা অনেক খুশি। যখন সৃজনশীল কিছু করতাম, অন্যরকম মজা পেতাম। যেটা মুখস্থ পড়া আর খাতায় নোট করার মধ্যে পেতাম না। বাংলাদেশের বর্তমান জব সেক্টর দেখলে খুবই হতাশ লাগে। তারপর যখন বিদেশে উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে জানলাম, পুরা ডেডিকেটেড হয়ে কাজ করেছি।’
তিনি আরও বলেন, আমার সফলতা পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান বলবো আমার বড় ভাইয়ের। একজন ভাইয়ের কী করা উচিত তার সর্বোচ্চটা সে করেছে। কোনো কিছুর কমতি সে কখনো আমার জন্য রাখেনি। সব সময় আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছ।’
সফলতার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আমার জন্য এই সফলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কারণ বাংলাদেশ থেকে খুব কম শিক্ষার্থীই আছেন, যারা সরাসরি আমেরিকার ফাইন্যান্সের পিএইচডিতে সুযোগ পায় । ফাইন্যান্সের পিএইচডি প্রোগ্রামগুলো খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়। সেখানে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিভাগ তিন বন্ধু একসাথে পিএইচডিতে সুযোগ পাওয়া অনেক গর্বের। সব চেয়ে ভালো লাগার বিষয় হলো তিন বন্ধু একসাথে পিএইচডি শুরু করা। আমরা তিনজনই একসাথে অনার্স চতুর্থ বর্ষ থেকেই গবেষণা শুরু করি। এখানে আমাদের তিনজনের সুপারভাইজার ড. বখতিয়ার হাসান স্যারের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। উনি না থাকলে হয়তো আমরা এই স্বপ্ন দেখার সাহসই পেতাম না।’
অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে সুমন আলী বলেন, ‘আমার বিভাগের এবং আমার পরিবারের জন্য এই সাফল্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সবচেয়ে মজার বিষয়, আমরা যখন ড. বখতিয়ার স্যারের পাবলিকেশন দেখতাম, তখন তিনজন আলোচনা করতাম আমারাও একদিন স্যারের সাথে পাবলিকেশন করবো।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.বখতিয়ার হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যবসায় শিক্ষার গবেষণা ওভাবে গড়ে ওঠেনি। সেক্ষেত্রে তাদের একটা লক্ষ্য ছিল বাহিরে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে। তাদের এই লক্ষ্য শুনে আমি সুযোগ করে দিয়েছি গবেষণা। তাদের পরার্মশ ও গাইডলাইন দিয়েছি । তারা তিনজনই ছিল অত্যন্ত মেধাবী এবং পরিশ্রমী। তবে এটা খুবই ব্যতিক্রমী যে তিন বন্ধু একই সাথে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে এর চেয়ে আনন্দ ও গৌরবের আর কিছু হয় না। এটাই আমার সবচেয়ে বড় সফলতা।’
এসআই/
মন্তব্য করুন