ডয়েচে ভেলে বাংলা: বাংলাদেশে সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ, সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কয়েকশত মানুষ৷ নিহতদের মধ্যে অনেক শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক রয়েছেন৷ এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার কীভাবে হবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা৷
বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ চলাকালে ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বিইউপির এমবিএর শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ৷ তার মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে ধারণকৃত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানির বোতল বিতরণ করছেন৷
মুগ্ধর সেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়৷ তার বলা ‘‘পানি লাগবে কারো, পানি?” দিয়ে বিভিন্ন দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে৷ সেদিনের কথা স্মরণ করে মুগ্ধর বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার ভাই, বা আমাদের পরিবারের সদস্যরা ছোটবেলা থেকেই সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ আমাদের বাবা আমাদেরকে সেভাবেই বড় করেছেন৷ শুধু এই আন্দোলন না, এর আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, তারপর বন্যার সময় ত্রাণ বিতরণ – এগুলোতেও ওরা ছিল৷ নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দিনেও একইরকমভাবে আমার দুই ভাই স্নিগ্ধ এবং মুগ্ধ পানি এবং বিস্কুট বিতরণ করেছিল৷ এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে যখন আগুন লাগে, সেখানে তারা উদ্ধার কাজ করতে গিয়েছিল৷ তার স্বীকৃতিস্বরুপ স্কাউটস থেকে তারা বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডসও পেয়েছিল৷”
‘‘সেই একইরকমভাবে এখানে মুগ্ধ মানুষদেরকে মানবতার খাতিরে সাহায্য করতে গিয়েছিল৷ তাদের জন্য পানি এবং বিস্কুট নিয়ে গিয়েছিল নিজের টাকা দিয়েই৷ সেখানে গিয়ে তাদেরকে পানি এবং বিস্কুট দিয়ে সহায়তা করছিল৷ এর মধ্যে সে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল,” যোগ করেন তিনি৷
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের একজন মুগ্ধ৷ আরেক শিক্ষার্থী গোলাম নাফিজ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে চার আগস্ট নিহত হন৷ সেদিন দিবাগত রাত ১২টার পর একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় তার ছবি প্রকাশিত হয়, যেখানে দেখা যায় যে, গুলিবিদ্ধ নাফিজ রিকশার পাদানিতে ঝুলছেন৷
নাফিজের বাবা গোলাম রহমান সেই ছবি দেখে তার সন্তানকে শনাক্ত করে মরদেহ সংগ্রহে হাসপাতালে গিয়েছিলেন৷ সেদিনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে রহমান বলেন, ‘‘চার আগস্ট সকাল এগারোটার দিকে আমার ছেলে আন্দোলনের উদ্দেশ্যে রওয়ান দিয়েছিল৷ শুরুতে সে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত গেছে৷ শাহবাগ মোড় থেকে ব্যাক করে আবার ফার্মগেটে এসেছে৷ পরে তিনটার সময় ওর মায়ের সাথে ফোনে কথা হয়েছে৷ তখন সে বলেছিল যে, আম্মু আমি আন্দোলনে এসেছি৷ তোমাদের কী অবস্থা? তখন তার মা বলেন যে, বাবা, ভালো আছি৷ তার মা তাকে বাসায় চলে আসতে বলেন৷ সে-ও আসবে জানায়৷”
কিন্তু তারপর আর ছেলের কোনো খোঁজ পাননি গোলাম রহমান৷ দিন গড়িয়ে রাত অবধি বিভিন্ন থানায় ঘুরেছেন তিনি৷ রহমান বলেন, ‘‘রাত বারোটার দিকে আমার আরেক ছেলে মানবজমিনে প্রকাশিত একটি ছবি দেখতে পায়৷ সেই ছবি দেখে নিশ্চিত হই যে, আমার ছেলে আর জীবিত নেই, মারা গেছে৷”
‘‘রাত সাড়ে তিনটার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখি আমার ছেলের লাশ সেখানে আছে৷ মাথার মধ্যে একটা পতাকা বাঁধা৷ সেদিন সকালে সে আমাকে বলেছিল আব্বু আমাকে বিশটা টাকা দেও৷ তখন আমার কাছে ১৩০ টাকা ছিল৷ আমি বলেছিলাম একশো টাকা নেও৷ সে বলেছে না, ত্রিশ টাকা দেও৷ ত্রিশ টাকা দিছি৷ সেই ত্রিশ টাকা দিয়ে সে একটা পতাকা কিনে মাথার মধ্যে বেঁধে রেখেছিল,” যোগ করেন তিনি৷
রহমান বলেন, ‘‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে, যেভাবে ওর শরীরে আঘাত করেছে, নাকে, মুখে, মাথায়, পায়ে৷ মনে করেন, এমন অবস্থায় আঘাত করেছে, আঘাতের পর আঘাত, আঘাতের পর আঘাত৷ এত আঘাত করেছে বলাবাহুল্য৷ একটা ছেলেকে একটা বাড়ি দিলেই যথেষ্ট৷ ওরা তো নিষ্পাপ৷ ১৬ বছরের ছেলে৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘তাকে এমনভাবে মারধর করেছে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার, খুব খারাপ অবস্থা৷ এরপর আবার বুকের মধ্যে গুলি করেছে৷ গুলিটা শরীর ছেদ করে বেরিয়ে যায়৷ খুব কাছে থেকে তাকে গুলি করা হয়েছিল বলে একজন ডক্টর জানিয়েছেন৷”
কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘাত, সংঘর্ষে কত মৃত্যু ঘটেছে?
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নানা পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে৷ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের উপর গুলিবর্ষণের একাধিক ভিডিও যাচাই করে সত্যতা নিশ্চিত করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷ বিভিন্ন থানাতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে৷
এসব সংঘর্ষ, সহিংসতা চলাকালে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে সেই হিসেব সরকারের তরফ থেকে এখনো জানানো হয়নি৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার প্রথম আলো নিজস্ব পন্থায় একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে৷ ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে সেটি আলাদাভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি৷
প্রথম আলোর হিসেবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম প্রাণহানি হয় ১৬ জুলাই রংপুরে৷ সেখানে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে জানিয়েছে৷
বাংলাদেশের জনপ্রিয় পত্রিকাটির হিসেবে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট সময়ের মধ্যে অন্তত ২১৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন, ৪ থেকে ৬ আগস্ট অবধি প্রাণহানির সংখ্যা ৩২৬ জন এবং ৭ আগস্ট থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৭ জন৷ অর্থাৎ, কোটা সংস্কার আন্দোলন, যা পরবর্তীতে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়, সেই আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ, সংঘাতে প্রাণ গেছে অন্তত ৫৮০ জনের৷ জাতিসংঘের হিসেবে অবশ্য সংখ্যাটি ছয়শ’র বেশি৷
এই আন্দোলন দমনে পুলিশ, র্যাব ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)-র বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে ব্যাপক গুলিবর্ষণের অভিযোগ রয়েছে বলেও লিখেছে প্রথম আলো৷ আর নিহতদের একটি বড় অংশই শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক৷ তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং সাংবাদিকও রয়েছেন৷ কিছু মানুষের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।
এসআই/
মন্তব্য করুন