সাব্বির হোসেন: ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সংগ্রামী বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে নিজ দেশকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছরে পদার্পণে স্বাধীনতা দিবসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাবনা তুলে ধরেছেন এডুকেশন টাইমসের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মো. সাব্বির হোসেন।
স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিমুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার কামনা
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ভুলে যে স্পৃহা নিয়ে বাংলার আপামর জনগোষ্ঠী ৭১ এর গণযুদ্ধে মাতৃভূমি রক্ষায় প্রাণ বিসর্জন দেওয়াকে কর্তব্য মনে করেছিলো, সেই স্পৃহা আর চেতনাকে পুনরায় ধারণ করতে, সেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে আবার ফিরিয়ে আনতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার কোনো বিকল্প নেই। যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখালো, মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলো, যুদ্ধকে সংগঠিত করে বাংলার স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দিলো, তাদের অনেকেই আজ রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের মারপ্যাঁচে ইতিহাসের অতল গহবরে হারিয়ে গেছেন।
এই স্বাধীনতা দিবসে দেশের মানুষ যেনো রাজনীতি আর ইতিহাস সচেতন হয়, সঠিক ইতিহাস জেনে দেশকে ভালোবাসতে শেখে, মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব এবং স্বাধীন দেশের মর্ম বুঝতে পারে এই কামনাই করি।
সুফিয়ান সোহাগ
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীনতা রক্ষা করার দীপ্ত শপথ হোক আমাদের মূলমন্ত্র
স্বাধীনতা হলো ব্যাক্তি তথা জাতির মুক্তির শ্রেষ্ঠ পাথেও। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা নামক প্রত্যয়টি অর্জন করেছি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী গতানুগতিকভাবে পূর্ব-বাংলা তথা বাংলাদেশের জনগণের উপর শিক্ষা, প্রশাসন, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের ধারা বজায় রাখে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। যা ছিল তৎকালীন নির্যাতিত উপেক্ষিত জাতির স্বাধীনতার পরোক্ষ ডাক। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকার ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। ফলের শেখ মুজিব ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ডাক দেয়। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে মেজর জিয়াউর রহমান পরবর্তীতে স্বাধীনতার ডাক দেন। ফলে আমজনতা মুক্তিযুদ্ধের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং সর্বোচ্চ বিসর্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে।
পরাধীনতার মানবজীবন বিকাশের অন্যতম অন্তরায়। তাই স্বাধীনতার এত আনন্দ ও গৌরবের। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করার দীপ্ত শপথ হোক আমাদের মূল মন্ত্র।
মো. মনসুর আলম
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
শোষণ-নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা দিবস প্রেরণা যোগায়
স্বাধীনতা দিবস আমাদের জীবনে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপুর্ণ ও ঐতিহাসিক দিন। দীর্ঘদিনের শোষণ, নির্যাতন বঞ্চনার অবসানের নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ আহ্বানে সাড়া দিয়ে এদিন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একটি অন্য মাত্রার সূচনা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ বাঙালি আপামর জনতা দৃপ্ত শপথে গর্জে উঠেছিল। পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন ও সার্বোভৌম বাংলাদেশের। বাংলার সহজ সরল সাধারণ মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক, কামার, তাতী, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে আপামর জনতা সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছিল আত্ম-অধিকার আর দেশমাতৃকার প্রয়োজনে তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।
স্বাধীনতা দিবস আমাদের প্রাত্যহিক ও জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। আজও স্বাধীনতার আনন্দে দেশবাসী এদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে দেশের অকুতোভয় বীর সৈনিকদের। শোষণ-নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা দিবস প্রেরণা যোগায়। আমাদের বিশ্বাস করায়, জনতার সম্মিলিত শক্তির কাছে শোষক-নিপিড়ক কখনোই তাদের অন্যায়-অত্যাচার চাপিয়ে দিতে পারবে না।
স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য পরাধীনতার নিগর থেকে মুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তি তথা জাতি হিসেবে আত্মোন্নয়ন করা। স্বাধীনতা আমাদের জীবনে নতুন বোধোদয়ের উদ্রেক করে, আমাদের ভাবতে শেখায়, সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন করতে শেখায়। বাংলাদেশের উন্নতি ও স্বনির্ভরতা অর্জনের অন্যতম অনুপ্রেণনা হিসেবে স্বাধীনতার ভূমিকা অপরিসীম।
বর্তমান বাস্তবতায়, স্বাধীনতা চেতনার কদর্য ব্যবহার আমাদের শঙ্কিত করে। নিকট ভবিষ্যতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আদৌ স্বাধীনতার আসল উদ্দেশ্য জানবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা করার যথেষ্ঠ কারণ আমরা প্রতিনিয়ত তৈরি করে যাচ্ছি। যে উদ্দেশ্য ও চেতনার উপর ভিত্তি করে বাংলার আপামর জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল তা আজ লক্ষ্য করা যায় না। কিশোর-তরুণদের সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা, নৈতিক অবক্ষয়, অপরাজনীতি, ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতা প্রদর্শন কিংবা সীমাহীন দুর্নীতি আজ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। স্বাধীনতার আসল লক্ষ্য থেকে আমরা প্রতিনিয়ত দূরে সরে যাচ্ছি যা দেশের উন্নতি ও সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনা ধারণের মাধ্যমে আমরা পারি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে। দেশের মানুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা, মেধা ও যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতিকে সফলতার পথে পরিচালিত করবে।
সোহান
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
হার না মানা মনোভাবে হোক স্বাধীনতা দিবসের অবিচল অঙ্গীকার
প্রথমেই জানাচ্ছি স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা, পরাধীনতার সেই দুঃসহ স্মৃতি চারণ করতে গেলে নবাব সিরাউদ্দৌলা থেকে শুরু করতে হবে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে পরাধীন হওয়ার পর ২০০ বছরের শোষিত হওয়ার ইতিহাসে তিতুমীর, ফরায়েজী, মজনু শাহসহ আরো অনেকের আন্দোলন ও যুদ্ধের পরও পরাধীন থাকা এই বাংলা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম পেয়ে মানুষের মনে যে আশার সঞ্চার করেছিল সেটাও ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে যখন পশ্চিম পাকিস্তান ক্ষমতার মসনদে বসে বাঙালির-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক বৈষম্য ঘটানোসহ সব অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে কেড়ে নেয়, ‘হায়’ স্বাধীন হয়েও হইলাম না স্বাধীন। শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন, বাঙালি জাতি শিকার হলো এক ভয়ানক গণহত্যার, চিরনিপীড়িত বাঙালির শেষ অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ অবসান ঘটলো ২০০ বছরের ও বেশি সময়ের পরাধীন অবস্থার, নিজের দেশে শত্রুর হানা, এবার আর ইংরেজ নয়, পাকিস্তানি মিলিটারির বিপক্ষে সর্বজনতার যুদ্ধ, ছিনিয়েই আনলাম স্বাধীনতা। এই সেই কাঙ্ক্ষিত ২৬ মার্চ, বাঙালির স্বপ্নসারথি রচনার দিন, যেই স্বাধীনতার বীজ বপন করলেন জাতির জনক, সেই বীজ আজ ফসল রূপে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ হওয়ার পথে। স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাই আমার বাংলাদেশকে। একই সঙ্গে ৫৩ বছর পরেও বিদ্যমান থাকা দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অগ্নিকাণ্ডসহ নেতিবাচক সকল বিষয় সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে উজ্জীবিত হোক দেশের মানুষ, এই প্রার্থনা রইলো সৃষ্টিকর্তার কাছে। ৩০ লক্ষ শহীদ, হাজারো মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা পেলাম, সেটাকে পুঁজি করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের পথের প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং সেই পথটা মসৃণ ও সুগম করাটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। পাশপাশি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেনো সাহসী বীরদের আদর্শ ধারণ করে ‘স্বাধীনতা অর্জন এর চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’ এই মতাদর্শে নিজেদের গড়ে তোলে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যেনো গড়ে ওঠে এই হার না মানা মনোভাবে, এটাই হোক স্বাধীনতা দিবসের অবিচল অঙ্গীকার।
রাফি আল ইসলাম পলক
শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
এসআই/
মন্তব্য করুন