মেহেদী হাসান খান সিয়াম: সভ্যতা বিকাশের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত অর্থাৎ পাথরের যুগ থেকে এ্যাটমের যুগ পর্যন্ত পৌঁছাতে যে প্রযুক্তিটি মানুষের কাছাকাছি থেকে আসছে সেটি হলো বায়োটেকনোলজি। মানুষ যখন উন্নত জাতের গাছগুলো নিজেদের গৃহের আঙ্গিনায় লাগাতে শিখেছিল তখন থেকেই বায়োটেকনোলজির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে মানুষ উন্নত জাত তৈরি করতে শুরু করে, ফার্মেন্টেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে রুটি ও মদ তৈরি করে, ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে দই তৈরির মতো বায়োটেকনোলজি টেকনিকগুলো বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে শুরুর দিকে এগুলো বায়োটেকনোলজি নামে পরিচিত ছিল না।
বর্তমানে এগুলোকে প্রাচীন বায়োটেকনোলজির অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়। আধুনিক বায়োটেকনোলজি বলতে গেলে আমাদের চোখের সামনে ভ্যাক্সিন, জেনেটিক্যালি মডিফাইড প্ল্যান্ট, ক্যান্সার গবেষণা ইত্যাদি বিষয়গুলো চলে আসে। করোনা মহামারীতে ভ্যাক্সিন আবিষ্কার ছিল বায়োটেকনোলজির অন্যতম একটি অর্জন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ব্যক্তিগত ঔষধের মাধ্যমে ঔষধশিল্পে যে নতুন ধারা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে এতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ থাকবে বায়োটেকনোলজিস্টদের। জিন থেরাপি, কৃত্রিম অঙ্গের মতো উদ্ভাবনগুলো বায়োটেকনোলজিস্টের হাত ধরেই বাস্তবিক হয়ে উঠবে। তাই আমাদেরকে অনাগত দিনকে স্বাগত জানাবার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং আসলে কী:
বায়োটেকনোলজি হলো বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যেখানে জীবন্ত প্রাণী অথবা জীবন্ত প্রাণীর উপাদান ব্যবহার করে মানুষের জন্য অথবা মানুষের পরিবেশের জন্য কল্যাণকর নতুন কিছু তৈরি করা হয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হলো আধুনিক বায়োটেকনোলজির অংশ। ডিএনএ এর মাধ্যমে জীবের বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় এটা তো আমরা সবাই জানি। একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারের মূল কাজ হলো, ডিএনএ কাটা ও জোড়া লাগিয়ে কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের কিছু তৈরি করা।
বায়োটেকনোলজির প্রকারভেদ:
ফিল্ড অনুসারে বায়োটেকনোলজিকে পাঁচটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়।
Red Biotechnology: বায়োটেকনোলজির এ শাখা ঔষধের উন্নয়ন, টিকা, থেরাপি ডায়াগনস্টিকস এবং বায়োফার্মাসিউটিক্যাল উৎপাদনসহ চিকিৎসা ও ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাপ্লিকেশনের উপর ফোকাস করে।
Green Biotechnology: উন্নত ফসল, বৃক্ষ এবং প্রাণী তৈরির জন্য জিন প্রকৌশল ব্যবহার করে কৃষিক্ষেত্র উন্নত করার বায়োটেকনোলজি। যেমন: জেনেটিকালি মডিফাইড ফসল, জৈব জ্বালানি ইত্যাদি।
Blue biotechnology: সামুদ্রিক বায়োপ্রোডাক্টস, অ্যাকুয়াকালচার এবং সামুদ্রিক বায়োমিমিক্রিসহ সামুদ্রিক ও জলজ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে।
Yellow biotechnology: খাদ্য সংযোজন এবং বায়োইঞ্জিনিয়ারিংসহ উন্নত পুষ্টি, খাদ্য ও পানীয় উৎপাদন সম্পর্কিত বায়োটেকনোলজি।
Gray Biotechnology: পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য জীবন্ত প্রাণী ও তাদের উপাদান ব্যবহার। যেমন বায়োরিমিডিয়েশন, শিল্প বায়োপ্রসেসিং।
সে সকল বিষয় পড়ানো হয় বায়োটেকনোলজিতে:
বায়োটেকনোলজি একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি সাবজেক্ট। যেহেতু বায়োটেকনোলজির এপ্লাইড ফিল্ড বিস্তর তাই মূল বিষয়গুলোর পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েরও প্রাথমিক বিষয়গুলো পড়ানো হয় যাতে একজন শিক্ষার্থী পরবর্তীতে তার পছন্দের ফিল্ডে মুভ করতে পারে।
Introduction to Biotechnology, Basic Biology, Biomolecules, Chemistry for Biology, Physics for Biology, Introduction to Computer Science, Human Physiology, Plant physiology, Molecular biology, Plan tissue culture, Mathematics, English, Genetics, Metabolism, Microbiology, Breeding, Enzymology, Nutrition, Immunology, Economics, Biostatistics, Clinical and Molecular Basis of Diseases, Recombinant DNA Technology, Virology, Bioinformatics, Microbial Genetics, Cancer biology, Molecular Genetics, Food Biotechnology, Fermentation Technology, Plant Genetic Engineering, Biopharmaceutical Chemistry, Medical and Pharmaceutical Biotechnology, Cell Biology, Computational Biology, Animal Biotechnology,
Forensic DNA Typing and Molecular Diagnostics, Protein and Metabolic Engineering, Downstream Biotechnology,
Environmental Biotechnology সহ ইত্যাদি কোর্স পড়ানোর পাশাপাশি ল্যাব ভিত্তিক অনেক টেকনিক শেখানো হয় এ সাবজেক্টে।
বায়োটেকনোলজির প্রয়োগ:
বায়োটেকনোলজির অনেকগুলি প্রয়োগ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
ঔষধ: ইনসুলিন, মানব বৃদ্ধি হরমোন এবং অ্যান্টিবায়োটিকের মতো ঔষধ তৈরি করা।
কৃষি: উন্নত ফসল তৈরি করা যা পোকামাকড়, রোগ এবং খরা প্রতিরোধী।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ: পনির, দই এবং রুটির মতো খাদ্য তৈরি করা।
পরিবেশগত রক্ষা: সামুদ্রিক তেল পরিষ্কার করা এবং দূষিত জল পরিশোধন করা।
যারা বায়োটেকনোলজিতে ভর্তি হবেন:
যদি আপনার গবেষক হওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে বায়োটেকনোলজি হতে পারে আপনার বেস্ট চয়েজ। মেডিকেলের ডাক্তারদের ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকবেন আপনারা। আপনাদের গবেষণা থেকেই মেডিকেল সেক্টর আরও উন্নত হবে। তাই গবেষক হয়ে পৃথিবীকে কিছু দিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন থাকলে আপনি এ সাবজেক্টকে বাছাই করে নিতে পারেন। এছাড়া আপনি যদি সৃষ্টিজগতের রহস্যগুলোকে আরও কাছ থেকে দেখতে চান তাহলে এ সাবজেক্ট আপনার জন্য। যেমন: একজন সাধারণ মানুষ একটা গাছের পাতার দিকে তাকালে সে শুধু একটা পাতাই দেখতে পাবে। আর একজন বায়োটেকনোলজিস্ট ঐ একই পাতার দিকে তাকালে দেখতে পাবে সালোকসংশ্লেষণ, জিন এক্সপ্রেশন ইত্যাদি।
বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য অবারিত সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে সাবজেক্টির ক্ষেত্র নতুন করে তৈরি হওয়া শুরু করলেও উন্নত বিশ্বে এটির ইতোমধ্যে প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে। তাই উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছে থাকলে এ সাবজেক্টকে বাছাই করতে পারেন।
তবে, এ ফিল্ডের জার্নিটা একটু দীর্ঘ। এ ফিল্ডে ভালো করতে হলে আপনাকে ভার্সিটির শুরু থেকেই পড়াশোনায় মনযোগী হতে হবে। ‘ভার্সিটি মানে চিল আর চিল’, ‘সারাদিন বন্ধু-বান্ধবীর সাথে গিটার নিয়ে গান গাওয়াই হলো ভার্সিটি লাইফ’ এই মোটিভেশানে অনুপ্রাণিত হয়ে যারা ভার্সিটিতে ভর্তি হবেন তাদের জন্য এ সাবজেক্ট গলার কাঁটা হতে পারে। তখন নিজের ডিপার্টমেন্টকে অভিশাপ মনে হবে। তাই এ সাবজেক্টে ভর্তি হওয়ার আগে এটা মাইন্ডসেট করে নিতে হবে যে, এখানে সাফল্য পেতে হলে টেবিলে অনেক সময় দিতে হবে। এর মানে এই না যে এ সাবজেক্টে পড়ে ভার্সিটি লাইফ এনজয় করা যায় না। আপনার মেজর ফোকাস পড়াশোনায় রাখলে আপনি অন্য সবকিছুই করতে পারবেন।
লেখক: মেহেদী হাসান খান সিয়াম
শিক্ষার্থী, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্য করুন