শাকিল শাহরিয়ার: ২৫ শে মার্চ ১৯৭১। বাঙ্গালীর জীবনে এক দুঃস্বপ্নের কাল রাত। এদিন দিবাগত রাতে মানব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ চালায় বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী। অপারেশ সার্চ লাইটের নামে বাঙালির কণ্ঠস্বরকে চিরতরে স্তব্দ করে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানীরা। বাঙালীর জীবনে নেমে আসে নিকষ কালো অন্ধকার এক রাত।
২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে আদেশ দেন ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে বাঙালিদের ও বিশেষ করে স্বাধীনতাকামীদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। আর সেই অপারেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোড নেম ছিল ‘বিগ বার্ড’। তাদের কাছে নির্দেশ ছিল বিগ বার্ড’কে না পেলে সারা ঢাকা শহর জ্বালিয়ে দিতে, শেখ মুজিবকে খুঁজে পেতে যদি লাখ লাখ মানুষকেও হত্যা করতে হয়, তা যেন পাকিস্তানিরা করে।
বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার নিয়ে অনেক প্রোপাগান্ডা চালু আছে। এর একটি হলো ২৫ মার্চ রাতে চাইলেই বঙ্গবন্ধু আত্মগোপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করেছেন। বিপ্লবে সরাসরি নেতৃত্ব না দিয়ে কিভাবে ধরা দিতে পারলেন! বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকেই এসেছিলো এর উত্তর। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা গোটা ঢাকা শহরের প্রতিটি বাড়ি খুঁজবে। জ্বালিয়ে দেবে, নিরীহদের হত্যা করবে।’ তার মানে তাকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে গণহত্যা ঠেকাতেই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৫ শে মার্চের গ্রেফতার অভিযান নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস’কে এক সাক্ষাৎকার দেন বঙ্গবন্ধু। এমন এক আক্রমণের কথা ভেবেই তিনি আগে থেকে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। সাড়ে দশটা নাগাদ তিনি চট্টগ্রামে এক গোপন ঠিকানায় যোগাযোগ করে দেশের মানুষের জন্য একটি বার্তা রেকর্ড করেন। পরে এই বার্তাটি একটি গোপন বেতার সম্প্রচার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচার করা হয়।
১৯৭১ সালের রাত ১১টায় ঢাকা শহরে সেনা হামলা শুরু হয়। খুব দ্রুত তা তীব্র আকার ধারণ করে। মধ্যরাত ও রাত ১টার মধ্যে শেখ মুজিবের বাড়ি লক্ষ্য করে সেনারা গুলি ছুড়তে শুরু করে। শেখ মুজিব তার স্ত্রী এবং কনিষ্ঠ পুত্রকে ঠেলে দোতলার ঘরে পাঠিয়ে দেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা তার বাসায় ঢুকে পড়ে। একজন দ্বাররক্ষী তাদের ঢুকতে দিতে অস্বীকার করলে সেনারা তাকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু বসার ঘরের দরজা খুলে বাইরে এসে সেনাদের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘গুলি থামাও, গুলি থামাও, গোলাগুলি কেন করছ? আমাকে যদি গুলি করতে চাও তো করো গুলি। আমি তোমাদের সামনে আছি। কিন্তু আমার দেশের মানুষের উপর ছেলেমেয়েদের উপর গুলি ছুড়ছো কেনো?’
আরেক পশলা গোলাগুলির পর একজন মেজর তার সেনাসদস্যদের থামার নির্দেশ দেন। তিনি শেখ মুজিবকে জানান তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। অতঃপর শেখ মুজিবের অনুরোধে তাকে কয়েক মুহুর্ত বিদায় নেবার জন্য সময় দেয়া হয়৷ পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে চুম্বন করে তিনি বলেন, ‘ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। তোমাদের সাথে হইতো আর দেখা হবে না। কিন্তু মনে রেখো আমায় দেশের মানুষ মুক্ত হবে, আমার আত্মা তা দেখে শান্তি পাবে।’
এরপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথমে জাতীয় সংসদ ভবনে অতঃপর ১৪ ডিভিশন অফিসার্স মেসে নিয়ে বন্দী করে রাখা হয়। পরদিন সেখান থেকে তাকে আদমজী ক্যান্টমেন্ট স্কুলের ৪ তলায় স্থানান্তর করা হয়। কয়েকদিন পর বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে করাচীতে নেওয়া হয়।
সে রাতে লে. কর্নেল জেড. এ. খান ও মেজর বেলাল শেখ মুজিবের বাড়িতে পরিচালিত অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন। শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের পর ৫৭ ব্রিগেডের কমান্ডর মেজর জাফর তার ওয়ারলেসে বলেন, ‘বিগ বার্ড ইন কেইজ’ আদার্স নট ইন দেয়ার নেস্ট’ ওভার। এখানে আদার্স বলতে জাতীয় চার নেতাকে বোঝানো হয়েছে।
লেখক: শাকিল শাহরিয়ার
শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়।
এসআই/
মন্তব্য করুন