এডুকেশন টাইমস ডেস্ক: মানিকগঞ্জের শিবালয়ের উথলী আব্দুল গণি সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইউছুব আলীর বিরুদ্ধে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠেছে। অভিযোগে বলা হয়, অনিয়ম-দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সুনামক্ষুণ করছেন প্রধান শিক্ষক। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয়-ব্যয় নিরিক্ষা ও তদন্ত কমিটির কাছে তার আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়ম ধরা পড়ে। এসব অভিযোগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে পরিচালনা কমিটি।
প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের (এসএমসি) সভাপতি মো. সালাহ উদ্দীন সরকার।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিবালয় উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন উথলী আব্দুল গণি সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৬ সালে। শুরু থেকেই এলাকায় বেশ সুনামের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়ে আসছে।
কিন্তু ২০১৬ সালে মো. ইউছুব আলী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা শুরু। পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ না করে একক সিদ্ধান্তে কেনাকাটাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে। তার আচরণে অতিষ্ঠ সবাই। অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নেমে এসেছে অর্ধেকে। নিজে ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করে জোরপূর্বক টিআর সদস্যদের দিয়ে স্বাক্ষর নিতেন। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলেই সহকারি শিক্ষকদের পাঠদানে বিরত রাখাসহ নানা হয়রানি করতেন প্রধান শিক্ষক। সম্প্রতি প্রধান শিক্ষকের শাস্তি চেয়ে বিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষক-কর্মচারী ও ১২৮ জন অভিভাবক পরিচালনা কমিটি বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিভাবক সদস্য ইসমাইল হোসেন জানান, আগে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ১২০০ থেকে ১৫০০ পযর্ন্ত। অথচ এখন শিক্ষার্থী মাত্র ৬০০ জন। প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সুবিধা অসুবিধার কোনো কথা শুনেন না। খারাপ আচরণ করেন। এ কারণে বিদ্যালয়ে দিন দিন ছাত্র/ছাত্রী সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
সহকারি শিক্ষক পলাশ খান জানান, বিদ্যালয়ে আয় থাকলেও, শিক্ষকদের স্কুল অংশের বেতন বন্ধ দীর্ঘদিন ধরে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা না দিয়ে তিনি টাকা অন্যখাতে খরচ করতেন। মূলত ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে তিনি সেই টাকা আত্মসাত করে আসছেন।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. আব্দুর রশিদ জানান, প্রধান শিক্ষক বিগত কমিটির কাছেও কোনো আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেননি। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আয়-ব্যয় হিসাব নিরক্ষণের উদ্যোগ নেই। অভ্যন্তরীণ নিরিক্ষা কমিটি ২০২৩ সালের স্কুলের আয়-ব্যয় হিসাবে ব্যাপক গড়মিল পায়। ব্যাংক লেনদেন, হিসাব খাতা এবং বিল ভাউচারের অমিল রয়েছে।
এ কারণে পরিচালনা কমিটির সভাপতির নির্দেশে অধিকর তদন্তের জন্য আমাকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেখানেও তার অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মেলে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কপি ঘেটে দেখা গেছে, বিধিমালা অনুযায়ি একজন প্রধান শিক্ষক মাসে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করে বছরে এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন। কিন্তু ২০২৩ সালে প্রধান শিক্ষক ইউছুব আলী বিধির্ভূতভাবে হাতে রেখে ১৬ লাখ ৬৩ হাজার টাকা খরচ করেছেন।
এ ছাড়া তিনি গত বছর স্কুলের ব্যাংক হিসাব থেকে ৬১ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলন করলেও ক্যাশ রেজিস্টার্ডে সেই টাকা উত্তোলন দেখানো হয়নি। পুরো টাকাই তিনি আত্মসাত করেছেন। শিক্ষকদের হাজিরা নিশ্চিতের জন্য দুটি বায়োমেট্টিক মেশিন কেনা বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৬১ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বাস্তবে ওই মেশিন দুটির দাম মাত্র ১২ হাজার টাকা।
বিদ্যালয়ে ওয়াইফাই ইন্টারনেট বিল খরচ প্রধান শিক্ষক প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা দেখালেও, বিল পরিশোধ করা হতো মাত্র ১ হাজার টাকা। প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে বছরে ২৪ হাজার টাকা তিনি নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন। এভাবে তিনি আপ্যায়ন, রশিদ বই ও লিফলেট ছাপানো, খেলাধূলা, যাতায়াত, স্টেশনারী ক্রয়, মামলা খরচসহ নানা খাতে ভুয়া বিল ভাউচার দাখিল করে অন্তত্ব ২০ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন।
বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি সালাহ উদ্দিন সরকার জানান, অভ্যান্তরীণ আয়-ব্যয় নিরিক্ষায় তার ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তারাও প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ পান। প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।এমনকি সবশেষ সভায় তিনি উপস্থিত থাকলেও রেজুলেশন খাতায় স্বাক্ষর না করেই চলে যান।
গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ ও বিধিমালা মেনেই গত ২৭ মার্চ তাকে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সেই সাথে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে সিনিয়র শিক্ষক হোসনে আরাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সাময়িক বরখাস্তকালীন সময় প্রধান শিক্ষক ইউছুব আলী মাসিক মূল বেতনের অর্ধেক খোরাকী ভাতা পাবেন এবং বিনা অনুমতিতে বিদ্যালয় চলাকালীন সময় কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে প্রধান শিক্ষক মো. ইউছুব আলীকে একাধিকবার ফোন করলেও, তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
শিবালয় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকতা মো. আবুল খায়ের জানান, প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্তের একটি অনুলিপি তিনি পেয়েছেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের। তাই তার কিছু করার নেই। তবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোন নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এসআই/
মন্তব্য করুন