বিবিসি: যুবা বয়সে ছিলেন কট্টর বামপন্থী। করেছেন বাম রাজনীতিও। ছিলেন কট্টর বামপন্থী একটির পত্রিকার সম্পাদকও। ক্যারিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে ছিলেন আইনজীবী হিসেবে। তবে রাজনীতির প্রতি অকৃত্তিম টান কখনো ছিন্ন হয়নি। এবার সেই রাজনীতির ক্যারিয়ারে চূড়ান্ত শিখরে উঠে এসেছেন তিনি। বলছি যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ের স্টারমারের কথা। যিনি হতে যাচ্ছেন দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
তার নেতৃত্বেই ১৪ বছর পরে সাধারণ নির্বাচনে বিশাল বিজয় অর্জন করে লেবার পার্টি আবারো ব্রিটেনের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসছে। নির্বাচনে জয়ের ফলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন স্যার কিয়ের স্টারমার।
গত ১৪ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে ছিল লেবার পার্টি। এবার নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। চার বছর আগে কট্টর বামপন্থী রাজনীতিবিদ জেরেমি করবিনের জায়গায় লেবার পার্টির নেতৃত্বে আসেন স্যার কিয়ের স্টারমার। রাজনীতির ময়দানের একেবারে কেন্দ্রে তার দলকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং ভোটে ভাল ফল করার জন্য কাজ করছেন তিনি।
রাজনীতির আগের জীবন
স্যার কিয়ের স্টারমার আইনজীবী হিসেবে বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের পর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সাংসদ হন পঞ্চাশের কোঠায় এসে। আইনজীবী হিসেবে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার থাকলেও রাজনীতি নিয়ে তার বরাবরই আগ্রহ ছিলেন সময়ের কট্টর বামপন্থী এই নেতা।
কিয়ের স্টারমার ১৯৬২ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের চার সন্তানের মধ্যে একজন, কিয়ের স্টারমার বেড়ে ওঠেন দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের সারে’তে।
শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে জীবনের যোগের কথা প্রায়শই বলতে শোনা যায় স্যার কিয়েরকে। তার বাবা একটা কারখানার সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক হিসাবে কাজ করতেন এবং মা ছিলেন নার্স। তার পরিবারও কট্টর লেবার পার্টির সমর্থক ছিল, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় তার নামে।
কিয়ের স্টারমারের নাম রাখা হয় স্কটিশ খনি শ্রমিক কিয়ের হার্ডির নাম অনুসারে তার নাম রাখা হয়েছিল। কিয়ের হার্ডি ছিলেন লেবার পার্টির প্রথম নেতা।
বড় হয়ে ওঠার সময় স্যার কিয়েরের পারিবারিক জীবন খুব সুখকর ছিল না। দূরত্ব রেখে চলতেন তার বাবা। মা জীবনের দীর্ঘকাল ‘স্টিল’স ডিজিজ’ নামক এক ধরনের অটো-ইমিউন ডিজিজে ভুগেছেন। রোগের কারণে ধীরে ধীরে হাঁটার এবং কথা বলার ক্ষমতা হারান তার মা। একসময় তার পা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির স্থানীয় যুব শাখায় যোগ দেন কিয়ের স্টারমার। কিছু সময়ের জন্য উগ্র বামপন্থী একটি পত্রিকার সম্পাদনাও করেছিলেন।
কিয়ের তার পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি শিক্ষা লাভ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন। লিডস এবং অক্সফোর্ডে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। ব্যারিস্টার হিসাবে মানবাধিকার নিয়ে কাজও করেছেন। সেসময় ক্যারিবিয়ান এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্তির জন্য তিনি কাজ করেন।
গত শতকের ৯০-এর দশকে একটা বিখ্যাত মামলায়, তিনি দু’জন ইকো-অ্যাক্টিভিস্ট বা পরিবেশ আন্দোলনকারীর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যাদের বিরুদ্ধে ‘ম্যাকডোনাল্ডস’ মামলা করেছিল।
২০০৮ সালে, কিয়ের পাবলিক প্রসিকিউশনের ডিরেক্টর এবং ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যার অর্থ, তিনি ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের সবচেয়ে সিনিয়র প্রসিকিউটর সরকারি কৌঁসুলি ছিলেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন। ২০১৪ সালে তাকে নাইট উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
লেবার পার্টির নেতা
২০১৫ সালে তিনি প্রথমবার সংসদে যান। লন্ডনের হবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাসের সাংসদ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কট্টর বাম রাজনীতিবিদ জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি তখন বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। অভিবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকলাপ নজরে রাখার জন্য স্যার কিয়েরকে ‘শ্যাডো হোম সেক্রেটারি’ (ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন জেরেমি করবিন।
যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেওয়ার পরে, স্যার কিয়েরকে ‘শ্য‘ডো ব্রেক্সিট মন্ত্রী’ হিসাবে নিয়োগ করা হয়। ২০১৯ সাল, সময়টা ছিল লেবার পার্টির জন্য খুবই খারা। সে সময় সাধারণ নির্বাচনের পর লেবার পার্টির নেতা হওয়ার সুযোগ পান কিয়ের। ১৯৩৫ সালের পর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে হেরেছিল দলটি। দলের এমন হারের কারণে জেরেমি করবিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
জল ও জ্বালানি কোম্পানির জাতীয়করণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষাদানের পক্ষে কথা বলে একটা বামপন্থী প্লাটফর্মে লেবার পার্টির নেতা হিসাবে জয় লাভ করেন কিয়ের।
জেরেমি করবিন লেবার পার্টিকে বামপন্থী এবং মধ্যপন্থীদের মধ্যে ভাগ করেছিলেন। কিয়ের লেবার পার্টিকে করার কথা বলেছিলেন। অন্যদিকে করবিনের চিন্তাধারাও ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে দলের মধ্যপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন কিয়ের।
জেরেমি করবিন দলের নেতৃত্বে থাকাকালীন ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছিল, তার জেরে তাকে সংসদীয় লেবার পার্টি থেকে বরখাস্ত করেন কিয়ের। তবে দলের বামপন্থী অনেকে বলেন, সংসদীয় প্রার্থী হিসেবে যাতে শুধুমাত্র মধ্যপন্থী সদস্যরাই দাঁড়াতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে স্যার কিয়ের দলের অভ্যন্তরে দীর্ঘমেয়াদী অভিযান চালাচ্ছেন।
এখন পরিস্থিতি কী?
কিয়ের স্টারমার তার নেতৃত্বের প্রচারণার সময় যাই বলে থাকুন না কেন, লেবার পার্টিকে নির্বাচনে লড়ার উপযুক্ত করে তুলতে দলকে মধ্যপন্থার দিকে নিয়ে গেছেন তিনি। একাধিক প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রেও চিত্রটা বদলেছে।
যুক্তরাজ্যের জনসাধারণের আর্থিক অবস্থার খারাপ অবস্থার কথা উল্লেখ করে কয়েকটা পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তিনি অনেক ব্যয়বহুল নীতি ত্যাগ করেছেন।
ইসরায়েল-গাজা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর গাজায় ইসরায়েলি অভিযান এবং সে দেশের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করেন কিয়ের। তার সিদ্ধান্ত অনেক ফিলিস্তিনপন্থী ভোটারদের ক্ষুব্ধ করেছিল। লেবার পার্টির বহু সাংসদ যারা সেই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাদের বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়েছিল কিয়েরকে।
তবে সম্প্রতি তাকে অন্য কথা বলতে শোনা যায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি স্থায়ী হয় এমন যুদ্ধবিরতির ডাক দিয়েছিলেন এবং জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন এটাই হওয়া উচিত!’
তবে যুক্তরাজ্যের ৫২ শতাংশ মানুষ মনে করে, ইসরায়েল-গাজার বিষয়টা সঠিকভাবে পরিচালনা করছেন না কিয়ের। গত মার্চে ‘ইউগভ’র এক জনমত জরিপে এমন চিত্র দেখা যায়।
ইউরোপ
২০১৯ সালে স্যার কিয়ের ব্রিটেনের ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ) ত্যাগ করা উচিত কি না, সে বিষয়ে দ্বিতীয় গণভোটের জন্য চাপ দিয়েছিলেন। তিনি এখন বলছেন, ব্রেক্সিট নিয়ে ফিরে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই।
তবে খাদ্য, পরিবেশ ও শ্রমের মানের মতো বিষয়ে ইইউ’র সঙ্গে নতুন সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার কথা জানিয়েছেন তিনি।
এসআই/
মন্তব্য করুন