এডুকেশন টাইমস ডেস্ক: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থমকে গেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎপরতা। চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ, দুই কমিশনার মো. জহুরুল হক ও আছিয়া খাতুনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিয়মিত অফিস করছেন না। কেউ কেউ অফিসে এলেও ঘণ্টাখানেকের বেশি অবস্থান করেন না। নীতিনির্ধারকদের অনুপস্থিতিতে দৈনন্দিন কার্যক্রমেও স্থবিরতা নেমে এসেছে। চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার এরই মধ্যে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আইন অনুযায়ী এটি একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বশাসিত সংস্থা। তবে দুদক কখনোই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের অভিযোগ, প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ আমলে না নিয়ে সংস্থাটি রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়রানিমূলক তৎপরতায় বেশি ব্যস্ত থাকে। মুখ দেখে দেখে দুর্বলদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো ব্যবস্থা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ উঠলেও ক্ষমতাসীন কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়নি দুদক। উল্টো বিরোধী দলের নেতাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। এ কারণে সরকার পতনের পর নিজেদের পরিণতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দুদক কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই ঠিকমতো অফিসে আসেন না শীর্ষ কর্মকর্তারা। গতকাল বুধবার দুদকে গিয়ে চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন কার্যালয়ে ছিলেন। দুপুর আড়াইটার দিকে বেরিয়ে যান তিনি। এ সময় দুদকের বর্তমান তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছে।’
কমিশনের নীতিনির্ধারকরা অফিসে না এলে কীভাবে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে—জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যান।
দুদকের একজন উপপরিচালক বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এরই মধ্যে পদত্যাগ করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তারা পদত্যাগপত্র তৈরি করে রেখেছেন। যে কোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন।’
ওই কর্মকর্তা জানান, দুদকের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের রাষ্ট্রপতি চায়ের নিমন্ত্রণ করেছেন। সেখানে কী ধরনের আলোচনা হয়, তার ওপর পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংস্থাটির ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। কর্মকর্তারা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছেন। যারা এতদিন ভালো পোস্টিং পাননি বা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন তাদের একটি গ্রুপ সরাসরি বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আর এতদিন যারা সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
জানা গেছে, ১৫ বছর ধরে লাল ফিতায় বন্দি থাকা অন্তত ৯৫টি ফাইল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সক্রিয় করতে চাচ্ছে দুদক। এসব ফাইলে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, ফরিদপুরের এমপি ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকজন ব্যবসায়ী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তার অভিযোগ জমা রয়েছে। সেগুলো নিয়েও এখন কাজ করতে চান কর্মকর্তারা।
দুদকের একজন উপপরিচালক বলেন, ‘বর্তমান কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থ। আমরা তাদের অধীনে আর কাজ করতে চাই না। তারা দুর্নীতি দমনে কোনো কার্যকর ভূমিকাই রাখতে পারেননি। সরকারের প্রেসক্রিপশনে কাজ করেছেন। তারা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যেমন ব্যবস্থা নেননি, তেমনি অনেক মানুষকে হয়রানি করেছেন। অনেক দুর্নীতিবাজের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত থামিয়ে দিয়েছেন।
দুদকের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘দুদক কর্মকর্তাদের উচিত ছিল অফিস যখন শুরু হয়েছে তখন থেকেই নিয়মিত অফিস করা; কিন্তু সেটা তারা করেননি। কারণ তাদের নিজেদের প্রতিই নিজেদের আস্থা নেই। তাদের সেই নৈতিক জায়গাটি নেই। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন সবসময়ই যারা সরকারে থেকেছে তাদের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছে।’
একটি উদাহরণ টেনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সাবেক ভূমিমন্ত্রীর অঢেল সম্পত্তির তথ্য আমরা প্রমাণসহ চলতি বছরের মার্চ মাসে দুদকে, বিআইএফইউ, সিআইডি ও অ্যার্টনি জেনারেলের কার্যালয়ে দিয়েছি। কিন্তু তারা কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই তরুণ প্রজন্ম যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের কথা বলছে, সেটি নির্মাণে এই কমিশনকে নতুন করে ঠেলে সাজানোর কোনো বিকল্প নেই।’
দীর্ঘদিন আটকে থাকা ৯৫টি ফাইল সচল করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি শুনতে ভালো লাগছে। তবে তা যেন লোক দেখানো না হয়। সঠিক তদন্ত হোক, এটাই প্রত্যাশা থাকবে।’
এসএস/
মন্তব্য করুন