এডুকেশন টাইমস ডেস্ক: মূল্যায়নভিত্তিক নতুন শিক্ষাক্রম থাকছে না, পরীক্ষাভিত্তিক পুরোনো শিক্ষাক্রমেই ফেরত যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এতে বিপাকে পড়তে যাচ্ছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ। কারণ, শিক্ষা উপদেষ্টা নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের পাশাপাশি বিগত সরকারের সময়ে রচিত পাঠ্যবইয়ের কাভার, কনটেন্ট বদলে ফেলারও ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। এর ফলে বিগত সময়ে টেন্ডার হওয়া বা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হওয়া বইগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতেই হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং ছাপাখানার মালিকরাও জানেন না ‘পাঠ্যবই’ নিয়ে কী হতে যাচ্ছে। পাঠ্যবই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার রেওয়াজ ধরে রাখতে চাইলে দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে হবে। অন্যদিকে, সরকারও কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের পরিকল্পনার কথা জানাবে বলে শোনা যাচ্ছে।
জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমের বই ২০২৩ সাল থেকে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। গত বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম এবং চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই পড়ানো হয়েছে। আগামী বছরের জন্য চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণির বই লেখার কাজ চলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোরও টেন্ডার হওয়ার পথে। কিন্তু জুলাই মাস থেকে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে বই প্রণয়নের কাজে ভাটা পড়ে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের ফলে বিপাকে পড়ে যায় সরকারি সংস্থাগুলো। ওই দিনের পর থেকেই সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এই তালিকায় ছিলেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলামও। তিনি সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। সেখানে একজনকে রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এনসিটিবির আরও কয়েকটি ঊর্ধ্বতন পদ ফাঁকা রয়েছে। এসব কারণে এবং দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাঠ্যবই নিয়ে ভাবার সময় পাননি অনেকে।
গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাক্রম অনেক দুর্বল। তবে আমাদের হাতে সময় নেই, যতটুকু পারি পরিবর্তন করা হবে। এ ছাড়া জানুয়ারি মাস আসতে বেশিদিন নেই। এর মধ্যে সারা দেশের পাঠ্যবই তৈরি করতে হবে। তিনি পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনারও ইঙ্গিত দিয়েছেন। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বইয়ের মলাটে যা আছে, সেগুলোর সংস্কার করতে হবে। আবার ভেতরে কিছু লেখা যাতে অতিদ্রুত সংশোধন করা যায়। বইয়ের কনটেন্টে কী পরিবর্তন আসবে, তা নির্ধারণে কমিটি গঠনের কথাও জানান তিনি। তার এসব মন্তব্যের পর পাঠ্যবই নিয়ে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির বই এখনো টেন্ডার হয়নি। একই অবস্থা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বইয়ের বেলায়ও। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের আন্তর্জাতিক টেন্ডার হয়েছে এক মাসের বেশি সময় আগে। এতে সর্বনিম্ন দর দিয়ে ১৬টি লটের কাজ পেয়েছে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান। নিয়ম অনুযায়ী, প্রেসের সক্ষমতা সরাসরি পরিদর্শন করে রিপোর্ট করে এনসিটিবির প্রতিনিধিদল। কিন্তু ওই প্রেস পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এখনো পরিদর্শন করতে পারেনি এনসিটিবি। এটি পরিদর্শন না হওয়ায় কাজ ঝুলে রয়েছে।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, আগামী বছরের জন্য নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের লেখালেখি চলছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আগেই যাচাই-বাছাই শেষে এটি এনসিটিবি থেকে মন্ত্রণালয়ে গেছে। গত ১২ আগস্ট অষ্টম শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার ড্রপ করা হয়েছে। নবম শ্রেণির বইও লেখালেখি চলছে। তবে টেন্ডার হয়নি। এ ছাড়া দশম শ্রেণির বই লেখা শেষ হয়েছে। তবে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি যায়নি।
ছাপাখানা মালিক ও এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস পুরোদমে শুরু হয়েছে গত ১৮ আগস্ট থেকে। কিন্তু বাজারে এনসিটিবির ছাপানো বই নেই। উচ্চ মাধ্যমিকের মোট পাঁচটি বই এনসিটিবি টেন্ডারের মাধ্যমে ছাপায়। তবে এগুলো বিনামূল্যে নয়। এই বইয়ের ওপর এনসিটিবি তথা সরকার প্রেসগুলো থেকে ন্যূনতম সাড়ে ১১ শতাংশ রয়্যালটি পায়। বইয়ে একটি দাম নির্ধারণ করা থাকে। সেগুলো খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়। প্রায় ৩৫ লাখ বইয়ের চাহিদা থাকলেও সেটি ছাপানো হয়নি। এসব সূত্র আরও বলছে, একদফা সময় বাড়ানোর পর আগামী ২৫ আগস্টের মধ্যে বই ছাপানোর সম্মতি দিতে হবে ছাপাখানাগুলোকে। দেশের পটপরিবর্তনের কারণে বই ছাপার কাজে রাজি হচ্ছেন না প্রেস মালিকরা। তাদের বক্তব্য, এই সময়ে সদ্য সাবেক সরকারের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন তথ্য রয়েছে—এমন কোনো কনটেন্ট বইয়ে থাকলে এবং সেটি ছাপালে যদি কারও চোখে পড়ে, তাহলে প্রেসের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। সে কারণে তারা কনটেন্ট কী থাকবে, তা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া ছাপাখানা মালিকরা টেন্ডারের শিডিউল কিনে রাখায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। সেজন্য খুব বেশি পরিবর্তন না করে কিছু কনটেন্ট বাদ দিয়ে বাকিগুলো ঠিক রেখে প্রশ্ন যোগ করে দেওয়ার দাবি তাদের।
এক ছাপাখানা মালিক কালবেলাকে বলেন, যেহেতু হাতে সময় খুবই কম, সেজন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। আমার মতে, বইয়ে পুরো পরিবর্তন অল্প সময়ের মধ্যে আনা কঠিন হবে। তা ছাড়া অনেক বইয়ের টেন্ডারও হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে বইয়ের কিছু কনটেন্ট যেহেতু বাদ যাবে বলে শুনছি, বাকি কনটেন্টগুলো ঠিক রেখে অনুশীলনের জায়গায় প্রশ্ন যোগ করে দিলে সবচেয়ে ভালো হবে। তিনি বলেন, বইয়ের কাভার পুরোটাই বাদ দিতে হবে। তবে ভেতরের কনটেন্ট বাদ দিয়ে দ্রুত সংশোধন করে দিলে ছাপার কাজ শুরু করতে পারব। তাহলে ডিসেম্বর না হলেও জানুয়ারির মধ্যে সব বই দেওয়া সম্ভব হবে। আরেকজন ছাপাখানা মালিক বলেন, যেহেতু কলেজের ক্লাস শুরু হয়েছে, সেজন্য দ্রুত এসব বইয়ের কনটেন্ট নির্ধারণ করা জরুরি। দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে কালোবাজারিরা পুরোনো বই ছাপানোর সুযোগ পাবে।
এনসিটিবি সূত্র বলছে, আগামী বছরও ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বই একই রাখা হতে পারে। তবে অনুশীলনের জায়গায় প্রশ্ন ঢোকানো হতে পারে। এ ছাড়া বিগত সরকারের সময় যুক্ত করা কিছু কনটেন্ট বাদ দেওয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে কিছু নতুন কনটেন্ট যোগ হবে। কাভার থেকে সাবেক সরকারপ্রধানের বাণী মুছে যাবে। কাভারের পেছনের দিকের ছবি বদলে যাবে। বঙ্গবন্ধুর ছবিও বাদ যেতে পারে। অন্যদিকে, নবম ও দশম শ্রেণির বই ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম অনুযায়ী হতে পারে। সেক্ষেত্রেও যেহেতু সাবেক সরকার ক্ষমতায় ছিল, কিছু কনটেন্ট বাদ যেতে পারে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যেহেতু চলতি বছর নতুন শিক্ষাক্রমের বই পড়ছে, আগামী বছর দশম শ্রেণিতে তারা পুরোনো শিক্ষাক্রমের বই পড়ে পরীক্ষায় যাতে খারাপ না করে, সেজন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে তাদের পরীক্ষা হতে পারে। তবে দশম শ্রেণিতে যেহেতু এ বছরও পুরোনো শিক্ষাক্রমের বই পড়ছে, তাদের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। তাদের পরীক্ষা আগের শিক্ষাক্রম অনুযায়ীই হবে।
এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, কী হবে, জানি না। টেন্ডার বাতিল হলে বই ছাপানো কঠিন হয়ে যাবে। কারণ, নতুন টেন্ডার দিয়ে কাজ আদায়ের মতো সময় হাতে নেই। অন্তত ছয় মাস লাগবে নতুন টেন্ডার দিয়ে সবকিছু করতে। তারপরও মন্ত্রণালয় থেকে যে নির্দেশনা আসবে, সে অনুযায়ীই সবকিছু করা হবে।
প্রথম-তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক মো. সাইদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, এ ক্ষেত্রে যারা কাজ পায়, তাদের ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ খুব কম। তারপরও তাদের বলা হয়েছে, প্রেসের ছাপার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ভিডিও ফুটেজ আমাদের যেন দেয়।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, এটি নীতিগত বিষয়। সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হবে, শুরুতে তা বাস্তবায়ন করব। এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছি। উচ্চ মাধ্যমিকের বইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকের বই নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। কনটেন্ট রাখা হোক কিংবা বাদ দেওয়া হোক, আমাদের আশা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা নির্দেশনা পাব। এরপর বই ছাপাতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগবে না। এটি নিয়ে আশঙ্কার কারণ নেই।
শিক্ষা সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ কালবেলাকে বলেন, এটি ঠিক যে হাতে সময় খুব কম। তবে বিষয়টি নিয়ে বেশকিছু উদ্যোগ রয়েছে। দ্রুতই সে উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের কাজে হাত দেব। কয়েকদিনের মধ্যেই সেটি দৃশ্যমান হবে। এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
এসএস/
মন্তব্য করুন