শাকিল শাহরিয়ার: ‘আমরা তো তিমির বিনাশী’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ সালকে বরণ নিতে প্রস্তুত পৃথিবীর কোটি বাঙালি প্রাণ। নববর্ষকে বর্ষকে বরণ করার সংস্কৃতি বাঙালির বেশ প্রাচীন ঐতিহ্য। বর্ষ বরণের এ উৎসবে এখন প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের শোভাযাত্রায় কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙতি থেকে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
নববর্ষ উদযাপনের নানা উৎসবের মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি একেবারেই নবীন। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলা নববর্ষের দিনে অর্থাৎ বাংলা বছরের প্রথম দিনে উদযাপিত হয়। বাংলা নববর্ষ আমাদের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য। কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের সংস্কৃতিতে এক নতুন সংযোজন।
মঙ্গল শোভাযাত্রার বয়স প্রায় ৪০ বছর। এই অনুষ্ঠানের গোড়াপত্তন হয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে। আরো পরিষ্কারভাবে বলা যেতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে। এই অনুষ্ঠান রাজনৈতিকভাবে শুরু হলেও এটি এখন সর্বজন স্বীকৃত একটি সামাজিক অনুষ্ঠান।
শোভাযাত্রা বর্ণিল রঙে রঙিন থাকে। আবহমান বাংলার বিভিন্ন লোকজ উপাদান এই শোভাযাত্রায় ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রা উপলক্ষে হাতে তৈরি করা হয় বিভিন্ন মুখোশ, মূর্তি, ট্যাপা পুতুল, নকশি পাখি, বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি।
এ শোভাযাত্রাকে শোভিত করার জন্য যে উপাদানগুলো লাগে, সেগুলো শুরু থেকেই নেওয়া হয় দেশের লোকশিল্পের নানা ধরনের খেলনা থেকে। এর বাইরে ঘোড়া, নকশি পাখা, ফুল, প্রজাপতি, মানুষ, প্রকৃতি এগুলো শোভাযাত্রায় স্থান পেতে থাকে।
বৈশাখী উদযাপনের ইতিহাস কয়েকশ বছরের পুরনো হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালের পহেলা বৈশাখে যশোরে। তখন দেশে ছিল সামরিক শাসন। উদ্দেশ্য ছিল দেশের লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা। আর সেই শোভাযাত্রায় অশুভের বিনাশ কামনা করে শুভশক্তির আগমনের প্রার্থনা করা হয়। এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন চারুশিল্পী মাহবুব জামাল শামিম।
১৯৮৯ সালে পহেলা বৈশাখে ঢাকার চারুকলা থেকেও শুরু হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরুতে এর নাম ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ ছিল। তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থাকে মাথায় রেখেই এমনটা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবেই পরিচিত হয়।
১৯৮৯ এর প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ এর আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তার নতুন মাত্রা লাভ করে।
চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীসহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালাকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম।কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশ খচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে-গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। দিনদিন এই শোভাযাত্রা আরো বর্ণিল হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘের সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে। ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তাদের ‘রিপ্রেজেনটেটিভ লিস্ট অব ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর ফলে পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা। এখন এটি বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ। বাঙালি সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।
২০১৭ সাল থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে কলকাতায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালেও আয়োজন করা হয়।
কলকাতার গাঙ্গুলিবাগান থেকে শুরু হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাপীঠ ময়দানে গিয়ে শেষ হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। এছাড়াও বেশ কয়েকটি মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। দুই বাংলার শিল্পীদের আঁকা নানান জিনিস থাকে সেই শোভাযাত্রায়।
তবে মঙ্গল শোভাযাত্রাও যে সব সময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল তা নয়। এই আয়োজন নিয়ে আগে থেকেই তাদের আপত্তি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠন। তাদের দৃষ্টিতে, এই শোভাযাত্রাটি হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে এসেছে।
কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজকেরা বলছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে কোনো ধর্মীয় বিষয়ের সম্পর্ক নেই এবং যেকোনো ধর্মের উৎসবের বাইরে বাঙালি হিসেবে সার্বজনীন একটি উৎসব হিসেবেই সূচনা হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার। শোভাযাত্রার বিষয়টা এখানে নতুন না, নতুন হচ্ছে সার্বজনীনতা।
তবে তর্ক-বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অপেক্ষাকৃত নতুন এই আয়োজনটি নিয়ে যে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে তা স্পষ্ট। প্রতি বছর লাখো মানুষের জনস্রোতে মঙ্গল শোভাযাত্রার সার্বজনীনতা ফুটে উঠে।
এসআই/
মন্তব্য করুন