সুমাইয়া শিমু: ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৪ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তার পুনঃনির্বাচনের ফলে বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন দিক উন্মোচন হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, তার নেতৃত্বের পুনরায় প্রতিষ্ঠা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলতে পারে? বিশেষ করে, ট্রাম্পের নীতি কি নতুনভাবে বাংলাদেশের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও গভীর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা। তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি নতুন পররাষ্ট্রনীতির মঞ্চ তৈরি করবে, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ব বিশ্লেষকরা ট্রাম্পের সম্ভাব্য নীতি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ইউরোপীয় মিত্ররা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মনে করে যে, মার্কিন নীতির পরিবর্তন এই অঞ্চলের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং কৌশলগত সম্পর্ককে নতুন আকার দিতে পারে। বিশেষত চীন ও ভারতের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক আরও বৈরী হতে পারে। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী চীনের রপ্তানি কার্যক্রমে ৬০% পর্যন্ত নতুন বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করা হতে পারে, যা চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই পরিবর্তন এশিয়ার দেশগুলোর উপর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যারা চীনের সাপ্লাই চেইনের ওপর নির্ভরশীল। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতার তীব্রতার মধ্যে বাংলাদেশ চীনের প্রযুক্তিগত ও অবকাঠামোগত সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ড্রোন প্রযুক্তি এবং বিশেষ করে পানি ব্যবস্থাপনায় চীনের সহযোগিতা বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ভারত-মার্কিন সম্পর্কের উপর বড় প্রভাব ফেলবে চীন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সরাসরি না দেখে বরং ভারত-কেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে এবং চীনের প্রেক্ষাপটে ভারতকে দেখার প্রচেষ্টা চালাবে। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে কৌশলগত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করার কারণে বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ, কারণ তাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে হবে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে উৎসাহিত করে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব কমানোর উদ্যোগ নিতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সংকট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের যে সহায়তা আসে, তার বেশিরভাগই জাতিসংঘের মাধ্যমে, যা মার্কিন অর্থায়নে সম্পন্ন হয়। তবে, ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক দর্শন এই ধরনের সহায়তা কমাতে পারে,বিশেষজ্ঞরা বলছেন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবার মনোযোগ দিবেন। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত মানবিক সংকটের ক্ষেত্রে।
সাধারণত, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন করেন, তখন মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে কোন বড় পরিবর্তন হয় না। তবে ট্রাম্পের নেতৃত্বে কী হবে তা অনিশ্চিত। বর্তমান সময় বিশ্লেষণ করলে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের পর জুলাই বিপ্লব এবং ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের একটি লক্ষণীয় উষ্ণতা দেখা দেয়। বাংলাদেশ বর্তমানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। ঢাকার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন উন্নয়ন সহযোগিতা এবং মানবিক সহায়তার ওপর ভিত্তি করে রয়েছে। তবে, ট্রাম্প প্রশাসন এই সম্পর্কের কাঠামোকে নতুনভাবে নির্ধারণ করতে আগ্রহী নাও হতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য, ট্রাম্পের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা উভয়ই রয়েছে।একদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি উল্লেখযোগ্য রপ্তানি বাজার হিসাবে অব্যাহত থাকার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, ভূ-রাজনৈতিক কারণ, যেমন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ছাপিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে হবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকে।
বর্তমানে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্রুত বদলাচ্ছে। বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার এবং কৌশলগত মিত্র। তাই ভবিষ্যতে উভয় দেশই কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে নতুন উপায় খুঁজবে।
বাংলাদেশকে মার্কিন বিনিয়োগের জন্য বাজার উন্মুক্ত করতে হবে ও শাসনব্যবস্থার উন্নতি, বিচার বিভাগীয় সংস্কার, এবং প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক ব্যবস্থায় প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: সুমাইয়া শিমু
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এসআই/
মন্তব্য করুন