বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর সাতদিন পুলিশকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এরইমধ্যে বাহিনীটিকে সচল করতে নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পুলিশের যেসব সংস্কারের কথা বলা হয়েছে তার অন্যতম পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগ।
সরকার পতনের পরদিন থেকে পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেন। গত রোববার স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ও নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সাথে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকের পর কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হলেও পুলিশের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি।
বিবিসি বাংলা সরেজমিনে দেখতে পেয়েছে পুলিশ সদস্যরা রাস্তায় উর্দি পরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করলেও, থানা এবং অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ সাদা পোশাকেই সারছেন। কেউ কেউ ইউনিফর্ম নিয়ে অস্বস্তির কথাও জানিয়েছেন।
রোববার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠকেই পোশাক-লোগো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এ বিষয়ে একটি কমিটিও করে দেয়া হয়েছে। তবে, বাহিনীর পোশাকের সঙ্গে পারফরম্যান্সের সম্পর্ক কতটুকু তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন সাবেক একজন পুলিশ মহাপরিদর্শক, প্রশ্ন আছে বিপুল ব্যয় নিয়েও।
আর বর্তমান আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম বলছেন, “পোশাক একটি মাইন্ডসেট (মানসিকতা) তৈরি করে।”
সে কারণেই পোশাক পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
‘অনেক খরচ করতে হবে’
২০০৯ সালের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালে বাংলাদশে রাইফেলস (বিডিআর) এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ(বিজিবি)। সেই সময় বাহিনীর মনোগ্রাম এবং পোশাকেও পরিবর্তন আনা হয়েছিল। বিজিবি একটি আধা সামরিক বাহিনী। অন্যদিকে, পুলিশ বেসামরিক বাহিনী।
“ওই সিচুয়েশন আর এই সিচুয়েশন এক নয়” মন্তব্য করে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মনে হয় না সিভিলিয়ান ফোর্সের ক্ষেত্রে, কী ইউনিফর্ম পড়ি তার সঙ্গে আমার পারফরম্যান্সের সরাসরি সম্পর্ক আছে”।
গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য সংখা প্রায় দুই লাখ। সদস্যদের পোশাক বাহিনীর পক্ষ থেকেই সরবরাহ বা অর্থায়ন করা হয়।
ফলে এই বিপুল সংখ্যক সদস্যের পোশাক পরিবর্তন বাবদ একটা বড় অংকের অর্থ খরচ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা।
এছাড়া, লোগো পাল্টাতে গেলেও বাড়তি ব্যয়ের প্রশ্ন আসছে। স্থাপনা, যানবাহনসহ অনেক ক্ষেত্রে নতুন লোগো প্রতিস্থাপন করতে হবে।
বিবিসি বাংলাকে মি. হুদা বলেন, “অনেক টাকা খরচ করতে হবে। এটা আমাদের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কতখানি ঠিক হবে সেটা যারা দেশের ফাইন্যান্স সম্বন্ধে ভালো জানে তারা ভালো বলতে পারবে”।
যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্য হয়তো ভালো কিন্তু, “ব্যয়টা অনুৎপাদনশীল খাতে হচ্ছে”, মনে করিয়ে দিতে চাইলেন তিনি।
এক সময় বাংলাদেশ পুলিশের ইউনিফর্মের রঙ ছিল খাকি।
“খাকি কলোনিয়াল রেজিমের (ঔপনিবেশিক শাসন) প্রতিনিধিত্বমূলক পোশাক” বলে মনে করেন বর্তমান আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম।
বিবিসি বাংলাকে আইজিপি বলেন, “এখন যেটা চলছে এই পোশাকটাও দীর্ঘদিনের। এই পোশাক পরে সাম্প্রতিক আন্দোলনে অনেক ঘটনা ঘটেছে।” অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে বলেও স্বীকার করেন মি. ইসলাম।
“এক্ষেত্রে যে হুকুমের কথা বলা হচ্ছে সেটাও আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করছি,” যোগ করেন তিনি। এসব প্রেক্ষাপটেই পোশাক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখেন তিনি। যাতে মানসিকতায় পরিবর্তন আসে।
‘ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে’
ছয়ই অগাস্ট দুপুরের পর থেকে বাংলাদেশের থানাগুলোতে কোনও পুলিশ সদস্য ছিলেন না। তার আগের দিন দেশের ৪৫০টিরও বেশি থানা ‘আক্রান্ত’ হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশ পুলিশ এসোসিয়েশন।
একযোগে সব থানা ফেলে পুলিশ সদস্যদের পালিয়ে যাবার ঘটনা অতীতে বাংলাদেশে কখনো দেখা যায়নি। থানায় থানায় এমন হামলা, অগ্নিকাণ্ড ও লুটপাটের ঘটনাও নজিরবিহীন। সব মিলিয়ে এই আন্দোলনের সময় ৪৩ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাহিনী প্রধান। তবে তার বক্তব্যে স্পষ্ট, পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভের ব্যাপারটি নিয়ে তিনি সচেতন।
বিবিসি বাংলাকে বলেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক জায়গায় অ্যাকসেস (বাড়াবাড়ি) হয়েছে।
“ইতিমধ্যে ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন (বিভাগীয় ব্যবস্থা) শুরু হয়ে গেছে,” যোগ করেন তিনি।
মঙ্গলবার একদিনেই উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার দু’জন কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন রংপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি মো. আবদুল বাতেন।
বিশেষ শাখা এসবির প্রধান অতিরিক্তি পুলিশ মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম ও সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়াকে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে।
সবমিলিয়ে অতিরিক্ত আইজিপি থেকে শুরু করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পর্যন্ত পদমর্যাদার ২৯ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।
“আমরা বাহিনীকে শুদ্ধ করতে চাই, কিন্তু, কারো অপরাধ ঢাকতে চাই না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা ‘ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশনের’ পাশাপাশি ফৌজদারি অপরাধের জন্য ফৌজদারি মামলার কথাও বলছেন।
“সবাইকে নিয়ে এখন কাজ করতে হবে। তার মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে সেগুলো দেখতে হবে। কিছু আনপ্লেজান্ট অ্যাকশন নিতেই হবে এখন,” বলছিলেন মি. হুদা।
বর্তমান আইজিপিও বলছেন, কোনো ফৌজদারি অপরাধ হয়ে থাকলে, সেই জায়গাগুলোতে ছাড় দেবেন না তারা।
কেমন পরিবর্তন চায় পুলিশ?
কর্মবিরতিতে যাওয়ার সময় পুলিশ এসোসিয়েশনের পক্ষে যেসব দাবি তুলে ধরা হয়েছিল তার অন্যতম, পুলিশকে রাজনৈতিক বা দলীয় প্রভাব মুক্ত রাখা।
আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, পুলিশ যেন ‘পার্টিজান রোল প্লে’ (দলীয় ভূমিকা পালন) না করে, পেশাদার ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করে সেজন্যই বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের সময় মানবাধিকারের বিষয় যাতে বিবেচনায় থাকে সেজন্য প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে চান মি. ইসলাম।
বলেন, “পুলিশ যেন বাড়াবাড়ি না করে, মানুষ যেন কমিউনিটি ট্রাস্টটা পায় সেই চেষ্টাই আমরা করবো।”
পুলিশ সদস্যরা শ্রম আইন অনুযায়ী আট ঘণ্টা ডিউটির ব্যবস্থা করার দাবি তুলেছিলেন।
আইজিপিও স্বীকার করলেন, “তারা ওভার বার্ডেন,” তাই তাদের কর্মঘন্টা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বর্তমান বাস্তবতায়, যারা গ্রহণযোগ্য কর্মকর্তা তারা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় দৃশ্যমান হতে হবে বলে মনে করেন সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা।
তাহলে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা সহজ হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
(বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন)
এসআই/
মন্তব্য করুন