সাদিকুল ইসলাম: বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে দুই দেশের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দাবিও করা হয়। দেশ দুটির মাঝে ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এই দীর্ঘ সীমান্ত ঘিরে প্রতিনিয়ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন সময়ে হত্যার শিকার অধিকাংশই বাংলাদেশি নাগরিক। যাদের ৯০ শতাংশই ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে হত্যার শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিদের হত্যাকাণ্ডগুলোর মাঝে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে কিশোরি ফেলানী হত্যাকাণ্ড। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় ফেলানী খাতুন। সীমান্তের কাঁটাতারে ফেলানীর ঝুঁলে থাকা লাশ বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় তুলে।
ঠিক তার ১৫ বছর পর আবারও একই ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটে গত ১ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে। ১৪ বছর বয়ষী কিশোরী স্বর্ণা দাসকে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। স্বর্ণা দাস মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্ত দিয়ে তার মায়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরায় অভিবাসী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন চট্টগ্রামের এক দম্পতি। রাত ৯টার দিকে তাঁরা ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গেলে বিএসএফ সদস্যরা গুলি চালান। এতে ঘটনাস্থলেই স্বর্ণা নিহত হয়। আহত হয় সঙ্গে থাকা দম্পতিও।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এমন মর্মান্তিক ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড কয়েক দশক ধরে চলছে। এতে নিহত হয়েছে ৬ শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিক। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রথম পাঁচ মাসে বিএসএফের গুলিতে ১৭ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছে। ২০২৩ সালে ৩১ জন বাংলাদেশি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। ২০২১ ও ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৮ ও ২৩।
আসকের হিসাবে এর আগে ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল—এই ১১ বছরে ৫২২ বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে মারা গেছেন।
সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গ উঠলেই বিএসএফ ‘আত্মরক্ষার জন্য’‘বাধ্য হয়ে’ গুলি চালানোর অজুহাত দাঁড় করায়। ২০২২ সালের জুলাই মাসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সম্মেলন শেষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিং বিএসএফের গুলিতে নিহত সব বাংলাদেশিকে অপরাধী বলে সাব্যস্ত করেছিলেন।
তবে আত্মরক্ষা কিম্বা চোরাচালান নয় বরং বাংলাদেশকে চাপে রাখতেই সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে বলছেন বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, ‘বাংলাদেশকে চাপে রাখতেই বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে বিএসএফ। এখানে টাকার ভাগবাটোয়ার বিষয় আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এর তেমন কোনো প্রতিবাদ জানানো হয় না।’
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না ভারত:
ভারত সব সময়েই দাবি করে আসছে সীমান্তে যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তারা অপরাধী। তার গরু চোরাচালানিসহ নান ধরনের পাচার ও অবৈধ কর্মকান্ডে যুক্ত। কিন্তু দুই দেশ অনেক আগেই সীমান্তে মারনাস্ত্র (লেথাল ওয়েপন) ব্যবহার না করার কথা বলে আসছে। কিন্তু সীমান্তে বিএসএফের হাতে হত্যার শিকার ৯০ ভাগই গুলিতে নিহত হয়েছেন। সীমান্ত হত্যা শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও তারা দিয়েছে বারবার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখছে না তারা।
সীমান্ত হত্যার নেপথ্যে কী?
ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সচিব কিরীটি রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘দুই মাস আগেও বলা হয়েছে সীমান্ত হত্যা কমানো হবে। কিন্তু কমছে না। ভারতের সরকার বলছে বিএসএফ তাদের কথা শুনছে না। এটা কীভাবে সম্ভব!’
তার কথা, ‘এই সীমান্ত হত্যার পিছনে যে গল্প ফাঁদা হয় তাও ঠিক না। তারা বলে সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান হয়। চোরাচালনিদের হত্যা করা হয়। মনে হয় যেন সীমান্তে গরু জন্ম নেয় আর তা বাংলাদেশে পাচার করা হয়। বাস্তবে এইসব গরু আনা হয় ভারতের অভ্যন্তরে দুই-আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে হরিয়ানা, পাঞ্জাব থেকে। গরুগুলো হাঁটিয়ে, ট্রাক, ট্রেনে করে আনা হয়। তখন কেউ দেখে না! তারা আটকায় না। কারণ তারা ভাগ পায়। এখানে আসল কথা হলো দুর্নীতি, ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে সব করা হয়। যখন ভাগ-বাটোয়ারায় মেলেনা তখন বিএসএফ হত্যা করে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশও এটা নিয়ে কিছু বলে না। কোনো জোরালো প্রতিবাদ করেনা। তারা জো হজুর জি হুজুর করে। এভাবে করলে তো পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। আর ভারত সরকার তো হিন্দুত্ববাদী মনোভাব থেকে মুসলিমদের টাইট দেয়ার কাজে ব্যস্ত।’
এসআই/
মন্তব্য করুন