সজীব চৌধুরী: মোটাদাগে সামষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মুদ্রাস্ফীতি, যা যেকোনো সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অন্যতম কারণ। করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় থেকেই এই নীরব ঘাতক এ দেশের মানুষের জন্য ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ এর মতো আঘাত করে চলেছে। বিগত সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত, মূল্যস্ফীতিকে গুরুত্ব না দেওয়া, এবং পরের কাঁধে নিজের দোষ চাপানোর প্রবণতার ফলেই আজকের এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যা দেশের মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসাবে, গত আগস্ট মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১০.৪৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে তা সামান্য কমে ৯.৯২ শতাংশে নেমেছে বলে দাবি করা হলেও বাজারে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। প্রায় সব পণ্যই এখনও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও, সেগুলোর ফলাফল দৃশ্যমান হতে সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেছেন মাননীয় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গে আসলেই, অর্থনীতিবিদরা সাধারণত সংকোচনমূলক অর্থনীতির ধারণাকে সামনে আনেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে, যা মূলত ভোক্তা এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ নেওয়া থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে খরচ কমাতে সহায়তা করে। অন্যদিকে, আমদানি ব্যয় হ্রাস, রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা এবং বাজার পর্যবেক্ষণ ও জরিমানা করার উদ্যোগগুলিও অব্যাহত রয়েছে। তবে, সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। এই সমন্বয়হীনতাই মুদ্রাস্ফীতি কমানোর প্রচেষ্টাগুলিকে আরো জটিল করে তুলছে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। হাইপার ইনফ্লেশনে (যেখানে দ্রব্যমূল্য অত্যন্ত দ্রুত হারে বাড়ে এবং মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা দ্রুত কমে যায়) পৌঁছানোর পর দেশটি এখন নেতিবাচক মুদ্রাস্ফীতির পর্যায়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কার সাফল্যের পেছনে তাদের নমনীয় মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্য (Flexible Inflation Targeting Policy), সেন্ট্রাল ব্যাংক ও সরকারের কার্যকর সমন্বয়, আর্থিক ও রাজস্ব নীতির সমন্বিত প্রয়োগ, সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন, মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা রক্ষা, জ্বালানির মূল্য সমন্বয় এবং আমদানি ব্যয় হ্রাসের মতো উদ্যোগগুলো ছিল অত্যন্ত কার্যকর।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আর্থিক নীতিতে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, রাজস্ব নীতিতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন, সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন বা জ্বালানি পণ্যের মূল্য সমন্বয়ে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে জ্বালানির দাম নিয়মিত সমন্বয় করা অত্যন্ত জরুরি। খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার এবং নতুন উৎস থেকে স্বল্পমূল্যে খাদ্যপণ্য আমদানির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। অথচ দেশে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে—সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের আমদানি ৩.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যার মধ্যে চিনির আমদানি ৫২.৫ শতাংশ কমেছে। বর্তমান সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা এবং ভবিষ্যতের জন্য আমদানির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা এখন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
এছাড়াও, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বাজার তদারকি কার্যক্রম হ্রাস পেয়েছে, যা চাঁদাবাজি ও অনিয়মকে বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে না পারলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে, যা বেকারত্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। এজন্য কঠোর আইন প্রয়োগ ও বাজার ব্যবস্থার কার্যকর তদারকি প্রয়োজন।
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ফলে ব্যবসায়ীরা সাময়িকভাবে অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন, কারণ ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মূলধন প্রবাহে সংকট দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনা বা নীতিগত সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে উৎপাদনশীল খাতগুলোকে সচল রাখা সম্ভব হবে।
স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ হিসেবে সরকারকে ওপেন মার্কেট সেল (OMS) কার্যক্রমে কঠোর মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিটি মহল্লায় স্থানীয় প্রতিনিধি, ছাত্র এবং সাধারণ জনগণের সমন্বয়ে OMS পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এর ফলে প্রকৃতপক্ষে যাদের এই সুবিধার প্রয়োজন, তারা তা সহজেই পাবে। তবে, এই কার্যক্রম সফল করতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মুদ্রাস্ফীতির মতো জাতীয় সংকট মোকাবিলায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকার, উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে আমাদের দেশ মুক্তি পেতে পারে।
লেখক: সজীব চৌধুরী
গবেষণা কর্মকর্তা (অর্থনীতি)
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা
এসআই/
মন্তব্য করুন