সাদিকুল ইসলাম: লাহোরে শুয়ে আছেন সাদাত হাসান মান্টো। তাঁর শিয়রে লেখা আছে, ‘এখানে সমাধিতে টন-টন মাটির তলায় শুয়ে আছে মান্টো। তাঁর বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প বলার সব কৌশল আর রহস্য। মাটির গভীরে শুয়ে তিনি ভাবছেন, ছোটগল্পের বড় লেখক কে, তিনি না খোদা?’
মৃত্যুর প্রায় ৬ মাস আগে ১৯৫৪ সালের ১৮ আগস্টে নিজের এপিটাফ লেখেন মান্টো। মারা যান ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি। মৃত্যুর আগেই নিজের এপিটাফে ছোটগল্প লেখা নিয়ে মান্টোর এমন বাজিধরা প্রশ্নের উত্তর অমিমাংসিতই থাক। তবে মিমাংসিত সত্য এই যে, ব্রিটিশদের সাথে ভারতের হিন্দু ও পাকিস্তানের মুসলমান নেতারা ‘বৈঠকে বসে’ যে পাওয়া স্বাধীনতা এনে ছিল সেই স্বাধীনতার যে নির্মম মূল্য ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে আটক পরা মানুষগুলো দিয়ে ছিল সেই দৃশ্য কলমের ড়গায় নির্গত কালিতে উর্দু অক্ষরের শব্দ ও বাক্যে স্বল্পাকারের বয়ানে তুলে ধরতে মান্টোর চেয়ে মুন্সিয়ানা কেউ দেখাতে পেরেছে কি? এমন প্রশ্নের মিমাংসিত উত্তরে কেবল একটি শব্দই আসে, ‘না’।
দেশভাগের দগদগে ক্ষত অনেকের মতো আমৃত্যু বয়ে বেড়িয়েছেন মান্টো। তার এই বয়ে বেড়ানো ক্ষতের প্রকাশ ছিল ঠিক ততোটাই নির্মম যতটা নির্মমতা সীমান্তের দুই পাড়ে ঘটেছে। ‘কালো সীমানা’র দুই পাড়ের কথাই তিনি বলে গেছেন ‘অশ্লীলতা’ ও নিষিদ্ধ শব্দের বেস্টনি উপেক্ষা করে।
সদ্য ভাগ হওয়া দেশ, নতুন সীমান্ত আর তার দুই পাড়ে জীবনের হাহাকার নিয়ে ১৯৪৮ সালে উর্দু ভাষায় রচনা করেন ৩২টি অণুগল্পের সংকলন ‘সিয়াহ হাশিয়ে’ (কালো সীমানা)। কোনো গল্প এক কিম্বা দু’লাইনের। আবার কোনোটা বড়জোর দুই পাতা। ‘বিন্দুতে সিন্দু ধারণ’ করে তুলে ধরেছেন বেঁচে থাকার তাড়নায় মানুষের নিরুদ্দেশ যাত্রার কথা। অনিশ্চত জীবন, মৃত্যুর ডাক তবুর জীবন বাঁচাতে ছুটে চলা মানুষগুলোর নির্মমতার দৃশ্যই ধরা পরেছে মান্টোর গল্পে, প্রবন্ধে, লেখনিতে।
মাতৃভূমি ভাগ করে পাওয়া স্বাধীনতার আনন্দ-উল্লাসে ‘দাঙ্গা, লুট ও হত্যা’ অভিন্ন কর্মে হিন্দু-মুসলমান-শিখের ঐক্য হয়ে গেলো। মারো, লুট করো স্বাধীনতার আনন্দে মাতো; দাঙ্গাই আসল ব্যবসা। ব্যবসা মানেই লাভ লোকসানের শঙ্কা-সম্ভবনা। দাঙ্গা ব্যবসায় সেই ‘লোকসান’র কথাই তুলে ধরেছেন মান্টো:
“দুই বন্ধু মিলে দশ-বিশজনের মধ্য থেকে একটা মেয়েকে বেছে বেয়াল্লিশ টাকায় কিনে নিল। মেয়ের নাম শুনে এক বন্ধু হতবাক হয়ে বলল, ‘আমাদের তো বলল তুমি অন্য ধর্মের!’”
‘ওরা মিথ্যা বলেছে।’ মেয়েটির জবাব। এ কথা শুনে বন্ধুটি ছুটে অন্য বন্ধুর কাছে বলল, ‘ওই হারামজাদারা আমাদের ধোঁকা দিয়েছে। চল মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে আসি।’ [লোকসান]
এমন ‘লোকসান’র পর মনোকষ্টেরই কথা। তাই তো আপন মনেই চলে আসে ‘সরি’। দাঙ্গার ব্যবসায় আরেকটি লোকসানের চিত্র পাওয়া যায় ‘কালো সীমান’র ‘সরি’ গল্পেও। মাত্র দুটি সাবলীল বাক্যে মান্টো তুলে ধরলেন দাঙ্গার অবিশ্বাস্য নির্মমতা:
“পেট ফাঁক করে দিয়ে নাভি পর্যন্ত নেমে এলো ছুরি।
পাজামার ফিতে কেটে গেল। ছুরি চালানো লোকটা সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, ‘ছি ছি ছি ছি, মিস্টেক হয়ে গেছে!’’’ (সরি)
এতো ভুলের মাঝেও কিছু তো লাভের গল্প থাকেই। তা না হলে আর দাঙ্গা চাঙ্গা কীভাবে ছিল? বা এখনো কী করে টিকে আছে ধর্ম কেন্দ্রীক আদিম ও নির্মম এই পেশা? ‘চ্যালেঞ্জা’ নিয়ে টিকে থাকার বয়ান করছেন মান্টো। মাত্র একলাইনে:
“আগুন লাগল যখন, সারা মহল্লা জ্বলে ছাই হলো… কেবল একটা দোকান বেঁচে গেল, সেই দোকানের ওপরে সাইনবোর্ডে এই তখনো পড়া যাচ্ছিল…‘এখানে বাড়ি বানানোর মাল-সামান পাওয়া যায়।’” (চ্যালেঞ্জ)
কেমন ছিল ১৯৪৭ সালে পাওয়া ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার স্বাদ? তারই সাক্ষা পাওয়া যায় ভারতে থেকে পাকিস্তানের ‘হিজরতকারী’ মোহাজের সিরাজউদ্দিনের মেয়ে সাকিনার ‘পাজামা’ খুলে দেওয়ার দৃশ্যে।
পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে ভাগ হয়ে যাওয়া পাঞ্জাবের অমৃতসর থেকে ট্রেনে করে পাকিস্তানে গিয়েছেন সিরাজউদ্দিন। আগেই মারা গেছে তার স্ত্রী।
“সে সিরাজউদ্দিনের চোখের সামনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। কিন্তু সাকিনা কোথায়? মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর সাকিনার মা মিনতি করেছে, আমার আশা ত্যাগ কর। সাকিনাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালিয়ে যাও।’
সাকিনা তার সঙ্গেই ছিল। দু’জনেই নগ্নপায়ে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাচ্ছিল। সাকিনার ওড়না পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। সিরাজউদ্দিন কুড়োতে গেলে সাকিনা চিৎকার করে উঠেছিল, আব্বা, ওটা ছেড়ে দিন…।’ কিন্তু সে তবুও তা কুড়িয়ে নিয়ে কোটের পকেটে রেখেছিল। এ-সব কথা ভাবতে গিয়ে সে ধীরে-ধীরে পকেট থেকে সাকিনার ওড়নাটা বের করে। এটা সাকিনারই ওড়না; কিন্তু সে কোথায়?”
সাকিনার ওড়ানা পড়ে যাওয়ার এমন চিত্রকল্প যেনো স্বাধীনতার গায়ের কাপড় খুলে যাওয়ারই দৃশ্য। সিরাজউদ্দিনের কাছ থেকে হারিয়ে যায় সাকিনা। মেয়েকে খুঁজছেন সিরাজউদ্দিন।
“ছয় দিনের মাথায় কিছুটা সামলে ওঠার পর সিরাজুদ্দীন কয়েকজন যুবকের দেখা পায় যারা তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল। আট জন যুবক ছিল ওই দলে। ওদের একটি লরি ছিল, বন্দুকও ছিল ওদের সঙ্গে। সিরাজুদ্দীন ওদের মঙ্গলকামনা করল আর সাকিনার চেহারার বর্ণনা দিল। “গায়ের রং ফর্সা আর খুব সুন্দরী…আমার মতো নয়, মায়ের রূপ পেয়েছে… সতেরো বছর বয়স…বড়ো বড়ো চোখ, ঘন কালো চুল…ডান গালে একটা বড়ো তিল…আমার একমাত্র মেয়ে। ওকে খুঁজে এনে দাও, খোদা তোমাদের ভালো করবেন।”
মন খুলে হাত তুলে স্বেচ্ছাসেবক যুবকদের জন্য দোয়া করলেন সিরাজউদ্দিন। মেয়ের সন্ধানের আশায় বুক বাঁধলেন।
একদিন সিরাজুদ্দীন ক্যাম্পে ছেলেগুলোকে দেখতে পায়। ওরা লরিতে বসেছিল। দৌঁড়তে দৌঁড়তে সে পৌঁছে যায় তাদের কাছে। লরিটি চলতে শুরু কারার মুখে সে জানতে চায়, ‘বাছা, তোমরা কি আমার সাকিনার কোনো খোঁজ পেলে?’
ছেলেগুলো সমস্বরে বলে উঠল, ‘খবর পাবে, খবর পাবে।’ এই বলে তারা দ্রুত লরির বেগ বাড়িয়ে ওখান থেকে সরে পড়ল । বুড়ো সিরাজুদ্দীন আরও একবার ওদের সাফল্য কামনা করে দোয়া করল এবং নিজেও একটু হাল্কা বোধ করল।
সেদিন সন্ধ্যায় সিরাজুদ্দীন চুপচাপ বসেছিল, হঠাৎ ক্যাম্পে একটা গুঞ্জন শুরু হলো। চারজন লোক কিছু একটা বয়ে নিয়ে আসছিল। খোঁজ নিয়ে সে জানতে পারল, রেললাইনের কাছে একটি মেয়েকে অচৈতন্য অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। লোকগুলো তাকেই উঠিয়ে এনেছে। সে-ও তাদের পিছু নিল। লোকগুলো মেয়েটিকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল।
কিছুক্ষণ সে হাসপাতালের বাইরে কাঠের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ল হাসপাতালের ভেতরে। ঘরের ভেতরে কেউ ছিল না, একটা স্ট্রেচারে একটা লাশ শোয়ান ছিল। গুটিগুটি পায়ে সে এগিয়ে গেল লাশটির দিকে। হঠাৎ ঘরে আলো জ্বলে উঠল। লাশটির ফ্যাকাশে মুখে একটি বড়ো কালো তিল নজরে পড়ল তার, সে চিৎকার করে উঠল, ‘সাকিনা!’
যে ডাক্তার ঘরে আলো জ্বেলেছিলেন, জানতে চাইলেন, ‘কী হলো?’ সিরাজুদ্দীন কাঁপাকাঁপা গলায় শুধু বলতে পারল, ‘আমি….আমি….আমিই ওর বাবা!’
ডাক্তার স্ট্রেচারে পড়ে থাকা লাশটির নাড়ি টিপে দেখলেন, তারপর জানলার দিকে ইশারা করে বললেন, ‘খুলে দাও।’
সাকিনার লাশ যেন হঠাৎ নড়ে উঠল…
নিথর হাতটা সালোয়ারের দড়িটা খুলে ফেলল আর সালোয়ারটা টেনে নীচে নামিয়ে দিল। বুড়ো সিরাজুদ্দীন আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বেঁচে আছে…..আমার মেয়ে বেঁচে আছে!’ [খুলদো: মান্টো]
দেশভাগ; হাজার বছর ধরে যে ভূমি ছিল আশ্রয় স্থল সেই ভূমিই যেনো মৃত্যুর কারণ হয়ে গেলো। জীবন বাঁচাতে ছাড়তো হলো সেই ঘর-আশ্রয়, বন্ধু-প্রতিবেশী-স্বজনদের। ছাড়তে গিয়ে কী হলো? উষ্ণ রক্তের দেহ হয়ে গেলো নিথর। দাঙ্গা, লুটতরাজ, আগুন আর খুনে মানব দেহ হয়ে গেলো ঠাণ্ডা; ‘ঠাণ্ডা গোশত’। অনেক ঈশ্বর সিংয়ের কাছ থেকে রেহাই পেলো না নিথর হিমশীতল সেই ‘ঠাণ্ডা গোশত’ও।
ঈশ্বর সিংয়ের সেই মানুষ যে, দাঙ্গার আগুনে আলু পোড়া খাচ্ছিলেন। তার আলু পোড়া খাওয়ার লালসা থেকে বাদ যায়নি যুবতীর লাশও।
গল্পটা এমনই:
অনেকদিন পর ভরা যৌবনবতী কুলবন্ত কাউরের হোটেল কক্ষে ঢুকল ঈশ্বর সিং, তখন রাত বারটা, শহর নিঝুম। কুলবন্ত তেজী নারী, থলথলে নিতম্ব, উদ্ধত স্তন। ঈশ্বর সিংয়ের পাগড়ি প্যাঁচ শিথিল হয়ে আসছে, হাতে কম্পমান ছুরা। যে কেউ বলবে তারা পরস্পরের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু ঈশ্বর সিং এতদিন কোথায় ছিল? কুলবন্ত কাউরের প্রশ্নের জবাবে জানায়, জানি না।
কুলবন্ত বলে, এটা পুরুষ মানুষের জবাব হতে পারে না।
তারপর কুলবন্তের শরীরে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। কুলবন্ত বলে, নিশ্চয়ই অনেক লুটপাট করেছ।
কিছুদিন আগেই লুটের স্বর্ণালঙ্কার কুলন্তের গায়ে চাপিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে যায়। তারপর আর খবর নেই।
মধ্যরাতে ঈশ্বর সিং কুলন্তকে দলিতমথিত করে জাগিয়ে তুলল, কিন্তু জাগরণ হলো না তার নিজেরই। নিজেকে শারীরিকভাবে সক্রিয় করতে যত পন্থা তার জানা ছিল, সব চেষ্টা একে একে ব্যর্থ হল। তার ব্যর্থতা ক্ষিপ্ত করে তুলল কুলবন্ত কাউরকে।
ঈশ্বর সিং যখন দেখল তার উত্থিত হওয়ার আর সম্ভাবনা নেই, নিশ্চুপ শুয়ে রইল বিছানায়। অতৃপ্ত কুলবন্ত চেঁচিয়ে উঠল, কোন হারামজাদিকে সব দিয়ে এসেছিস? কসম, আমিও সর্দার লেহাল সিংয়ের বেটি, মিথ্যে বললে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব। বল কে সে নারী যে তোর সকল জীবনীশক্তি শুষে নিয়েছে?
এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত কুলবন্ত ঈশ্বর সিংয়ের কৃপাণ খুলে তাকে আঘাত করল, ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল। অতৃপ্ত নারী, যত প্রিয়জনই হোক, ভয়াবহ হয়ে উঠে।
কুলবন্ত ঈশ্বরের চুলের মুঠি ধরে আছড়াতে থাকে। একজন নারী নিশ্চয়ই তার আর ঈশ্বরের মাঝখানে ঢুকে পড়েছে।
ঈশ্বর সিং নিরুত্তর।
কুলবন্ত জিজ্ঞেস, বলছিস না কেন? সে কি তোর মা?
এই ভয়াবহ রূঢ়তার মধ্যে ঈশ্বর সিং মুখ খুলে, কুলবন্ত এই কৃপাণ দিয়ে আমি ছ`জনকে হত্যা করি।
খুন আর লুটতরাজের কাহিনীর দরকার নেই তার। সে শুধু নিশ্চিত হতে চায় কোন নারী ঈশ্বর সিংকে নিঃশেষ করেছে তার পরিচয়। কৃপাণের আঘাতে রক্তপাত হচ্ছে তারও। ফিনকি দিয়ে গোঁফের উপর উপর ছিটকে পড়া রক্ত ফুঁ দিয়ে সরিয়ে ঈশ্বর সিং বলে, ছ`জনকে খুন করেছি আর খুব সুন্দর একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে এসেছি।
ঈশ্বর সিং বলে, কুলবন্ত আমি তাকেও খুন করতাম কিন্তু একবার মনে মনে হল তোকে তো প্রতিদিনই পাই। এমন সুন্দর একটি মেয়েকে একবারও ভোগ করব না?
ঈশ্বর সিং সেই সুন্দরীকে কাঁধে নিয়ে খালের ধারে একটি ঝোপের আড়ালে শুইয়ে দিল। তারপর শুরু করল প্রাক শৃঙ্গার পর্ব। তারপর যখন ব্যাপারটা ঘটতে যাবে ঈশ্বর সিংয়ের বর্ণনা হঠাৎ নিষ্প্রাণ হয়ে গেল।
কুলবন্ত জিজ্ঞেস করল, তারপর কি হল?
ঈশ্বর সিং বলল, টের পেলাম এটা একটা মৃতদেহ। আগেই সে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। পুরোপুরিই ঠাণ্ডা গোশত।
কুলবন্ত যখন ঈশ্বর সিংয়ের হাতে হাত রাখে অনুভব করে হাতটাও ঠাণ্ডায় জমে গেছে। [ঠাণ্ডা গোশত: মান্টো]
এসব গল্পে মান্টোর শব্দের গাথুনি শ্লীল-অশ্লীলের বাধায় আটকায়নি। অবলীলায় বলে গেছেন দেশভাগের নির্মমতার গল্প। দাঙ্গা, লুটতরাজ ও খুনের পৈশাচিক দৃশ্যের বয়ান দিয়েছেন আপন ভঙ্গিমায়। গল্পগুলোর পড়ার সময় অজান্তের শরীর শীতল হয়ে আসে। মনে হয় যে, ছুরি চালিয়ে দেওয়া গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে গায়ে লাগছে। অজান্তেই মুখ ফসকে বের হয়ে যায় ইশ!
দেশভাগে ছিল এমনই; হিন্দুর ভারত আর মুসলমানের পাকিস্তানের স্বাধীনতা ছিল এমনই, খুনে লাল ছিল ‘স্বাধীন ভূমি’। সেই লাল খুনের গল্পই তুলে ধরেছেন মান্টো। তবে স্বাধীন ভূমিতে মান্টোর স্বাধীনতা ছিল না। মুসলমান মান্টো ছিলেন, দেশ ও ধর্মের সাক্ষাৎ শত্রু।
একদিকে দেশভাগের তীব্র যন্ত্রণা, জন্মভূমির বিচ্ছেদ, স্বজন-বন্ধু ও চিরচেনা বম্বের সাহিত্য-সংস্কৃতি-চলচ্চিত্র জগৎ ছেড়ে মান্টোও অন্য সবার মতো জীবন বাঁচানোর তাগিদে হিন্দুর ভারত ছেড়ে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন মুসলমানের পাকিস্তানে। তবে পাকিস্তানে কাটানো জীবনের ৮টি বছর ছিল বিস্বাদ, যন্ত্রণা, দারিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্থ। অর্থাভাব আর পারিবারিক কলহ ছিল নিত্যসঙ্গী।
টন-টন মাটির তলে গল্প লেখার সমস্ত শিল্পকৌশল ও রহস্য নিয়ে যে মান্টো শুয়ে আছেন তার শেষ জীবন কেটেছে চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে তাকে ঔপনিবেশিক আদালতের মুখোমুখী হতে হয়েছে আর মুসলমানের পাকিস্তানে তাকে ফতোয়া ও আদালতের মুখোমুখী হতে হয়েছে। ‘নিষিদ্ধ’ ও ‘অশ্লীল’ শব্দে গল্প লেখার কারণে তাকে মামলার মুখোমুখী হতে হয়েছে; লেখার উপরেও এসেছে নিষেধাজ্ঞা। চাকরি হারাতে হয়েছে পত্রিকা অফিস থেকে। পরিবারের জন্য এক বেলা খাবার জোগাতে ও নিজের শরাব পানের অর্থের জন্য পত্রিকা অফিসে গিয়ে সম্পাদকের কাছে টাকার জন্য ধর্ণা দিতে হয়েছে। সাদা কাগজে কয়েক লাইনের গল্প লেখে দেওয়ার বিনিময়ে অর্থোপার্জন করে সংসার চালাতে হয়েছে।
রোগে-শোকে ভোগে শেষ বিদায় হয়েছে মান্টোর। হয়তো সেই অভিমানেই পৃথিবীকে সবগুলো গল্প দিয়ে যাননি! মান্টো লাহোরে শুয়ে আছেন তবে ‘নিষিদ্ধ’ ও ‘অশ্লীল’ শব্দে লেখা গল্পগুলো উর্দু সাহিত্যে সূর্যালোকের মতো জ্বলজ্বল করছে। ঠিক যেনো মান্টোর লেখা প্রবন্ধ ‘কাফনের গলা’য় ব্যবহার করা মির্জা গালিবের সেই লাইনগুলোর মতো:
‘ভেবো না আমি নিভে গেছি,
ভোরের সূর্যের মতো
প্রেমের দাগ আমার কাফনের গলায় অলংকার হয়ে আছে।’
শুভ জন্মদিন নিষ্প্রভ আলো সাদাত হাসান মান্টো।
লেখক: সাদিকুল ইসলাম
সাংবাদিক ও লেখক।
মন্তব্য করুন